বিএনপি ভোট বর্জন করায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারপরও অধিকাংশ আসনে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়নি; বরং ১০৪টি আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপরীতে থাকা সবাই জামানত হারিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ২৯৮টি আসনের ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে ভোটের এমন চিত্র দেখা যায়। বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, এবার মাত্র ৩২টি আসনে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, যেখানে বিজয়ী ও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান ১০ হাজারের কম। এই ব্যবধান ২০ হাজারের কম ধরলে এই সংখ্যা হয় ৫৭। বাকি ২৪১ আসনে কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না।
এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে ভোট পড়ার হার ৪১ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও এ হার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভোটে হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগের ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকে নিজ নিজ আসনে জাল ভোট এবং শেষ বেলায় প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ এনেছেন। একই অভিযোগ আওয়ামী লীগের জোটের শরিক ও মিত্র দলের নেতারাও করছেন। এর মধ্যেও ২১টি আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা দুই লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন।
২০১৪ সালের দশম সংসদ ও ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক আছে। দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি; অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
তবে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত আগের নির্বাচনগুলোর মতো গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ জামানত হারাননি। ওই নির্বাচনে ২৩০ আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সেবার দলটির বিজয়ী প্রার্থীরা ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিলেন মোট ৫টি আসনে।
৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ভোট হয় ২৯৯টিতে। এর মধ্যে একটি আসনের (ময়মনসিংহ-৩) ফল স্থগিত আছে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ভোটে অংশ নেয় ২৮টি। স্বতন্ত্রসহ মোট প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৯৬৯ জন। নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের বড় অংশই জামানত হারাতে যাচ্ছেন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে জিতেছেন ২৮০ আসনে। জাতীয় পার্টি ১১টি এবং কল্যাণ পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের প্রার্থীরা একটি করে আসনে জিতেছেন। অন্য স্বতন্ত্র জিতেছেন চারটি আসনে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাকি ২৩ দলের প্রার্থীদের মধ্যে একজন ছাড়া অন্য সবাই জামানত হারিয়েছেন।
নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ২০ হাজার টাকা নির্বাচন কমিশনের অনুকূলে জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়। সংসদীয় আসনে মোট প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, তাহলে তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এবার ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপরীতে অন্য দলের প্রার্থী দ্বিতীয় হয়েছে, এমন আসনগুলোতে ভোটের ব্যবধান অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই হাজার ভোটও পাননি। আর যেসব আসনে নৌকার বিপরীতে আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন, সেসব আসনে ভোটের ব্যবধান তুলনামূলক কম।
স্বতন্ত্র ও জাতীয় পার্টি ছাড়া নৌকার প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, তৃণমূল বিএনপি ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ সমঝোতা করে প্রাপ্ত আসনগুলোতে নৌকা প্রতীকে ভোট করেছে।
ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি যেখানে
ঢাকা জেলা ও মহানগরের ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতেই আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৫ হাজারের কম ভোট পেয়েছেন ১০ জন। মাত্র ৩টিতে বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে মোটামুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পেরেছেন দ্বিতীয় হওয়া প্রার্থীরা।
ঢাকা-৮ আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি পেয়েছেন ৪৬ হাজার ৬১০ ভোট। এই আসনে মোট প্রার্থী ছিলেন ১১ জন। এর মধ্যে বাহাউদ্দিনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির জোবের আলম খান পান ৮৮০ ভোট।
ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৫৯ ভোট। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিকল্পধারার আইনুল হক কুলা প্রতীকে পেয়েছেন ১ হাজার ৩৮০ ভোট।
নড়াইলের দুটি সংসদীয় আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপরীতে দ্বিতীয় হওয়া প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন। নড়াইল-১ আসনে বি এম কবিরুল হক ও নড়াইল-২ আসনে মাশরাফি বিন মুর্তজা লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী পান পাঁচ হাজারের কম ভোট।
ভোলা জেলার চারটি সংসদীয় আসনেই নৌকার প্রার্থীরা লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। বাকি সব প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।
কুমিল্লার ১১টি আসনের ৬টিতেই আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি সব প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচটি আসনের নৌকার প্রার্থীরা জিতেছেন লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে। একই চিত্র ফেনী-১ ও ফেনী-২ আসনসহ আরও কিছু আসনের ফলাফলে দেখা গেছে।
২ লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়
যেসব আসনে আওয়ামী লীগের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা দাঁড়াতে পারেননি এমন ২১টি আসনে নৌকা জিতেছে দুই লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ-২ আসনে শেখ ফজলুল করিম (সেলিম) সবচেয়ে বেশি ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৭ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। তিনি পেয়েছেন ২ লাখ ৯৫ হাজার ২৯১ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির কাজী শাহীন পেয়েছেন ১ হাজার ৫১৪ ভোট।
পৌনে ৩ লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনে তানভীর শাকিল (জয়)। আড়াই লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন মির্জা আজম (জামালপুর-৩), শরীফ আহমেদ (ময়মনসিংহ-২) ও দীপংকর তালুকদার (রাঙামাটি পার্বত্য জেলা)।
‘এবারের নির্বাচনে অনেকগুলো অদ্ভুত ও অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সাধারণত যেসব আসনে প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে ভোটার উপস্থিতি বেশি হয়। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র দেখা গেছে।
এই নির্বাচন বিশ্লেষকের মতে, এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। সরকারি দল অনেক ধরনের কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু ভোটার উপস্থিতি ছিল কম।