উচ্চ আদালত থেকে পদত্যাগকারী ফুলতলা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আকরাম হোসেনের প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার সংবাদে মুহুর্তের মধ্যে ডুমুরিয়ার ১৪টি এবং ফুলতলার ৪টি ইউনিয়নে নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।
নির্বাচনের বাকি মাত্র ৬ দিন। এরই মধ্যে আসনটিতে নৌকা এবং ঈগল প্রতীকের মধ্যে নির্বাচনী লড়াই জমে উঠেছে। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর কর্মী, সমর্থকরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। ভোটারদের নিয়ে চলছে প্রার্থীর উঠান বৈঠক, পথসভা, গণসংযোগ। জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর হুমকি প্রদানের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। চায়ের দোকান, গ্রামের পাড়া-মহল্লা, হাটে-ঘাটে, বাজারে ভোটের লড়াইয়ে কে জিতবে? এ নিয়ে শুরু হয়েছে সরব আলোচনা।
আসনটি থেকে মোট ৪ জন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও মূল প্রতিদ্বন্দিতা হবে আওয়ামী লীগের নারায়ণ চন্দ্র চন্দের নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেনের ঈগল প্রতীকের মধ্যে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আকরাম হোসেন প্রার্থী হওয়ায় বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে চ্যালেঞ্জের মুখে যেমন পড়েছেন নৌকার প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। একইভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় বিজয় হওয়ার ব্যাপারে শেখ আকরাম হোসেনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন বলে সচেতন মহল মনে করছেন। যদিও উভয় প্রার্থী বিজয় হওয়ার ব্যাপারে চ্যালেঞ্জের বিষয়টি মানতে নারাজ। দু’জনই বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।
এদিকে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এ আসনটিতে ৮ম, ৯ম, ১০ম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একচেটিয়া ভোট পেলেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আকরাম হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটে বিভাজন দেখা দিয়েছে। ডুমুরিয়া এবং ফুলতলা উপজেলার সংখ্যালঘু ভোটারদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
ফুলতলা উপজেলার বিল ডাকাতিয়া গ্রামের সংখ্যালঘু ভোটার সুজন কুমার গাইন খুলনা গেজেটকে বলেন, “আমাগে এলাকায় চেয়ারম্যানের (শেখ আকরাম হোসেন) দিক সাপোর্ট বেশী।
নৌকার প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাগে এলাকায় সেই হয়ে গেছে আনতালি আমাগে দিক কোন সময় ফিরেও তাকাই না। একটা অনুষ্ঠান করলাম ৪০/৫০ জন খাইয়ে চলে গেলো, তা চ্যারেনা পয়সাও দেলো না। ভালো ব্যবহার করিনি সেইজন্য সংখ্যালঘুরা তার পক্ষে নেই। এলাকায় সিরাম উন্নয়ন করিনি। সিরাম আসে না, সেই হয়ে গেছে আর কোন সময় দ্যাহে না যে ব্যাঁচে থাকলো কি মরে গেলো”।
ফুলতলা উপজেলার আটরা গিলাতলা ইউনিয়নের গিলাতলা দক্ষিণপাড়ার অধিবাসী পলাশ স্বর বলেন, “এবার বুঝা যাচ্ছে দু’জনের পক্ষেই কোটাকুটি হবে নৌকা এবং ঈগলের প্রার্থীর মধ্যে। নারায়ণ বাবুর আগের মতো সেই প্রভাব নেই, আস্তে আস্তে কমে গেছে। সে আগে চেয়ারম্যানের মাধ্যমে কম বেশি আসতো। সেই প্রভাবটা তার নেই।
তিনি বলেন, সে যে এমপি তাকে মাঝেমধ্যে এলাকায় ঘুড়া লাগে। সেইডা কিন্তু সে কম বেশি আসে না। এই কারণে তার প্রতি একটু ক্ষোভ আছে। এইডা সত্যি কথা এই কারণে অনেকে তার কাছ থেকে মুখ ফিরাই নিচ্ছে। হিন্দু কি আর মুসলমান কি? অনেকে হিসাব করতিছে চেয়ারম্যান (আকরাম হোসেন) আমাগে ধারে আছে”।
ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর গ্রামের সুব্রত মন্ডল বলেন, “নির্বাচন মোটামুটি চলতিছে দুই গ্রুপে প্রতিদ্বন্দ্বী। দুই গ্রুপে সমানভাবে চলতিছে। পাবলিগের কোন উত্তেজনা নেই। নারায়ণ বাবুর লোকজনও আছে বিরোধীও আছে। সমানে সমানে চলতিছে। ২/১ ধরে একটু জমজমাট বেশি হইছে”।
ফুলতলা উপজেলার আটরা গিলেতলা ইউনিয়নের বিল ডাকাতিয়া গ্রামের নিতীশ মন্ডল বলেন, “নির্বাচনে অবস্থান মাঝে ভাই’র আকরাম সাহেবের অবস্থান একটু ভালো। নারায়ণ বাবুর অবস্থান খারাপ, কারণ তিনি কয় বছরে আমাগে সামনে হাজির হয়নি। সে ক্যান্ডিডেট খারাপ না, কিন্তু জনগণের সামনে হাজির নেই বলে তার প্রতি সাপোর্ট দিচ্ছে না। আসেনা এই কারণে তার উপর অসন্তুষ্ট ক্ষিপ্ত”।
বিল ডাকাতিয়া গ্রামের আরেক সংখ্যালঘু ভোটার বাবুরাম গাইন বলেন, “নির্বাচনে ঈগলের পক্ষে খুব ভালো। ৯০% ভোট পাবে। ভোটার উপস্থিতি হবে। নারায়ণ বাবুর অবস্থা একটু খারাপ। কারণ সে কোন উন্নয়নমূলক কাজ করিনি। সে আমাগে সামনে তেমন আসে না”।
ডুমুরিয়া উপজেলা রঘুনাথপুর ইউনিয়নের কেমরাইল গ্রামের সঞ্জয় মন্ডল বলেন, নির্বাচনে জমজমাট ভাব। মোট প্রার্থী তো ৪ জন। তার মধ্যে প্রতিদ্বন্দী দুইজন। শান্তশিষ্ট ভাবে দুই দল প্রচারণা চালাচ্ছে। পক্ষ তো থাকবে তার ভিতরে দু’জন সব জায়গায় থাকবে। উনি (নারায়ণ চন্দ্র চন্দ) এলাকায় ভালো কাজ করে থাকে তাহলে ভোট পাবে। সে তো ভালো কাজ করিছে, সে মন্ত্রী ছিলো। বাড়ির পাশে আকরাম সাহেব দাঁড়াইছে এই কারণে সংখ্যালঘু ভোটে বিভাজন হয়েছে”।
ডুমুরিয়ার রংপুর ঠারুন তলার মুকুন্দ সরকার বলেন, “আমাগে ওয়ানে হয়তো নারায়ণ বাবুর পক্ষে ভালো। এমনি ঈগল পাখি একটু কম পাবেনে। নারায়ণ বাবু একটু আধটু সংযোগ রাখে। আমলীগ ছাড়া কোন লোক নেই। ঈগলের পক্ষেও কাজ করতিছে”।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন এই আসন থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন ইউসুফ। ২০০০ সালের ৬ অক্টোবর তার মৃত্যুর পর একই বছর ২০ ডিসেম্ব অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সর্বপ্রথম এমপি নির্বাচিত হন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। এরপর থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৮ম, নবম, দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদের মতো ৫ম বারের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন। ২০০১ অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট প্রার্থী অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ানের কাছে হেরে যান। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এমপি হন।
এদিকে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আকরাম হোসেন আসনটি থেকে দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় দীর্ঘদিন থেকে এলাকায় গণসংযোগ করে আসছিলেন। দলীয় মনোনয়নের আশায় তিনি অনেক চেষ্টা, তদবির এবং জোর লবিং ও করেছেন। সর্বশেষ দল থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় তিনি গত ২৯ নভেম্বর স্বেচ্ছায় উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আকরাম হোসেন এক সময় ফুলতলা উপজেলার দাপুটে জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন। খুলনায় জাতীয় পার্টির নীতি নির্ধারকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম একজন। ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালেও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এরপর আওয়ামী লীগে যোগদান করে তার দক্ষতা এবং যোগ্যতায় বাগিয়ে নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ। নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হওয়ায় তার নিজ এলাকা ফুলতলা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের মানুষ দল মত নির্বিশেষে একট্টা হয়েছেন তার ঈগল প্রতীকের পক্ষে। ডুমুরিয়া উপজেলার ১৪ টি ইউনিয়নেও রয়েছে তার অসংখ্য সমর্থক।
খুলনা গেজেট/এনএম