প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পাশাপাশি দীর্ঘদিনের শরিক ১৪ দলের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি দু-একদিনের মধ্যেই ফয়সালা হবে। কারণ, হাতে সময় নেই। যা করার ১৭ ডিসেম্বরের আগেই করতে হবে। দলগুলোর প্রার্থীরা কে কোন আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন, এর প্রাথমিক একটা খসড়াও প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে শরিক চারটি দলের পাঁচ শীর্ষ নেতাকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। ছাড় দেওয়া আসনে দল মনোনীত কোনো প্রার্থী থাকবে না। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।
সূত্রটি জানায়, আওয়ামী লীগ ছাড় দেওয়ায় ১৪ দলের আরেক শরিক বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী এবারও চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে নৌকা নিয়ে ভোটে অংশ নিচ্ছেন। ১৪ দলের বাইরে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি. চৌধুরীকে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে ছাড় দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের অন্য দুই শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া-২ আসন এবং আরেক শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বরিশাল-২ আসন, একই দলের সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী-২ আসন থেকে নৌকা নিয়ে ভোট করবেন। এসব জায়গায়ও আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী থাকবে না। তবে ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদের চাওয়া বাকি আসনের বিষয়ে বুধবার পর্যন্ত ফয়সালা হয়নি। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের দেনদরবার চলছে। দু-একদিনের মধ্যে বিষয়টি ফয়সালা হবে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদের নেতারা।
জানা যায়, মুখে যাই বলুক না কেন, আসন সমঝোতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে দফায় দফায় আলাপ-আলোচনা চলছে। গোপনীয়তা রক্ষা করে সোমবার রাতেও এ দুই দলের সিনিয়র নেতারা বৈঠক করেন। এর আগেও তারা কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকবে না, এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ক্ষমতাসীনরা। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে কী করা হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কতটি আসনে সমঝোতা হবে, এ নিয়ে এখনো দরকষাকষি চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ছাড় পাওয়া আসনে জাতীয় পার্টি অতীতের মতো এবারও তাদের দলের নির্বাচনি প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে ভোটযুদ্ধে অংশ নেবে। ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে চার দলের নেতারা ছাড় পাওয়া আসনে বরাবরের মতোই আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতীক নৌকা নিয়ে ভোট করবেন। এসব আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের কাউকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ করা হবে না। তবে এখনো এই সমঝোতায় প্রধান বাধা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হবে-এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে এই চেষ্টা কতটা কার্যকর হয়, এ নিয়ে এখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন সমঝোতা করে ভোটে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে চূড়ান্ত ফয়সালার বিষয়ে নতুন কোনো অগ্রগতি নেই। কবে নাগাদ সমঝোতা চূড়ান্ত হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখা যাক, আশা করি শিগগিরই হয়ে যাবে।
এদিকে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে আপস করার সুযোগ নেই। তারা এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি বলেছে, তারা নির্বাচন করতে চায়, জোটে থাকতে চায়। নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কথা তারা বলেনি। তবে আশঙ্কা থাকতে পারে। আমরা নিশ্চিত হতে চাই। এ নিয়ে অস্থিরতার কারণ নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আওয়ামী লীগ ওঠাবে না। স্বতন্ত্র ইস্যুতে শরিকদের সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই।
আসন সমঝোতার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আসন সমঝোতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। তবে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। আশা করছি, দু-একদিনের মধ্যে ঠিক হবে।
এদিকে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে শুরু থেকেই কৌশলী আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসাবে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা এবার জোটের নেতাদের শর্ত দিয়েছে-ভোটে জিতে আসতে পারবেন, এমন প্রার্থী হতে হবে। এ শর্ত পূরণ করার সামর্থ্য কয়টি দলের আছে, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই আছে যথেষ্ট সন্দেহ। কারণ, এমন প্রার্থী হতে হলে মাঠে তার ব্যাপক পরিচিতি ও বিপুল জনসমর্থন লাগবে। ছোট দলগুলো তাই দরকষাকষির মাঠে শুরুতে বড় সংখ্যা দিলেও তা শেষ পর্যন্ত কমিয়ে আনছে। এছাড়া শুরু থেকেই শরিকদের আপত্তি ছিল আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে। সমঝোতা হওয়া আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরই বসানোর দাবি ছিল তাদের। কিন্তু এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ এখনো শরিকদের আশ্বস্ত করলেও কী ব্যবস্থা নেবে, তা বলা হয়নি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে দলটি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে চাইছে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে শরিকরা।
এদিকে আওয়ামী লীগের কয়েক দফা বৈঠকের পরও শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ রোববার রাতে আওয়ামী লীগের সমন্বয় টিমের সঙ্গে বৈঠক করে ১৪ দলের শরিকরা। ওইদিনও তাদের চাহিদার লিস্ট ছোট করা হয়। এই শর্ট লিস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি জোটনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন বৈঠকে জানানো হয়। বৈঠক শেষে জোট নেতারা বলেন, তারা আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আওয়ামী লীগের কাছে শর্ট লিস্ট দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আওয়ামী লীগ আরও সময় চেয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টি-জেপি মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, এবারের নির্বাচন পরিস্থিতি একটু বিচিত্রও বটে। আওয়ামী লীগ সম্ভবত গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মতো কৌশল প্রয়োগ করতে চায় যেন ভোটার উপস্থিতি ভালো হয়। তিনি আরও বলেন, শুধু ১৪ দলের শরিক নয়, আওয়ামী লীগের প্রার্থী যারা আছেন, তাদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি করছে। এখন আওয়ামী লীগের যে কৌশল, সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া তো আমাদের গত্যন্তর নেই। আসন সমঝোতা নিয়ে ১৪ দলীয় জোট শরিকদের আর কোনো বৈঠক হবে কি না-জানতে চাইলে শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, আমার মনে হয় না আর কোনো মিটিং হবে। এখন যেটা হবে সেটা হলো, জানিয়ে দেওয়া হবে তারা কী করেছেন।
জানতে চাইলে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, আমাদের নির্বাচনের আগেই বসে ফয়সালা করার দরকার ছিল। কিন্তু এ কাজটা হয়নি। আওয়ামী লীগ যে কৌশলের কথা বলছে, সেগুলো আসলে কোনো কৌশল নয়, এগুলো অপকৌশল। কারণ, রাজনীতিতে ন্যূনতম নৈতিকতা থাকতে হয়, যা এখানে অনুপস্থিত। এতে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। নিজেদের নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের পাঁচজন প্রার্থী জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা আমাদের দলীয় প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবেন।
তবে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন মনে করে, ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে শরিকদের আসন সমঝোতা হয়ে যাবে। জানতে চাইলে দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ১৫ তারিখের মধ্যেই আসন সমঝোতা হয়ে যাবে। যারা জোটের প্রার্থী হবেন, তাদের নামে চিঠি ইস্যু হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান বলেন, এখনো সমঝোতা হয়নি। আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগ আরও একটু সময় চাইছে, যাচাই-বাছাই শেষ হলে মনে হয় একটা সমাধান হবে। আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে আগের অবস্থানেই আছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দলের ২১ জন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আর আওয়ামী লীগের কাছে তিনটি আসন চাওয়া হয়েছে। এগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে।