২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ দিনটি কয়েক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দিক দিয়ে এর গুরুত্ব বেশি। এ দিন সরকারি ও বিরোধী দলগুলো ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকে। সংঘাতের কারণে রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়। পুলিশ বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় জনগণ সে সব নিয়ে ভাবছেন। সম্প্রতি ২১ নভেম্বর তারিখে যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দেশ কি নৈরাজ্যের দিকে যাচ্ছে?’ শীর্ষক লেখায় এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছি। এ প্রবন্ধে শিক্ষকতা জীবনের কিছু ব্যক্তিগত বিষয় আলোচিত হবে।
২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল আমার শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন। ঐদিন থেকে আমার এলপিআর শুরু হয়। আর ২০০৩ সালের ২৮ অক্টোবরের আন্দোলন মূখর দিনে এলপিআর শেষ হয়ে আমার চার দশকের শিক্ষকতা জীবনের অবসান ঘটে। সবাই বিষয়টিকে এভাবে দেখলেও আমার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। আমি অবসর গ্রহণকে শিক্ষকতা জীবনের পরিসমাপ্তি ভাবি না। আমার দৃষ্টিতে একজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষকের অবসর নেবার সুযোগ নেই। তার শিক্ষকতা আমৃত্যু চলতে থাকে। যে এক বছর আমি এলপিআর-এ ছিলাম সে সময়টায় আমি ক্লাস নেইনি। একেবারেই যে ক্লাস নেইনি তা নয়। অতিথি শিক্ষক হিসেবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় বিভাগে কয়েকটি লেকচার দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। পরে তাদের অনেকে আমাকে ফোন করেছেন। আমিও তাদের দু’চারজনকে ফোন করেছি। লেখাপড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নতুন তথ্য জেনেছি। তারাও আমার কাছ থেকে একাডেমিক জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়েছেন। ডিজিটাল যুগের সুবিধা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে।
চার দশকের শিক্ষকতা জীবনে আমি শ্রেণিকক্ষেই সময় কাটিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত বর্ণের রাজনীতিতে জড়িত না হওয়ায় অন্য কোনো দায়িত্বপালনের সুযোগ পাইনি। এ জন্য আমি শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সময় দিতে পেরেছি। কোনো শিক্ষার্থীই আমার কাছে এসে ফিরে যাননি। আমার অফিস কক্ষের দরজা ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব সময় খোলা থেকেছে। নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও আমার কাছে এসেছেন। তারা কেবল লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করেননি। অনেক ব্যক্তিগত বিষয়ও শেয়ার করেছেন। ফলে তাদের সাথে আমার মধুময় সময় কেটেছে। এ কথা সত্য, সকল ছাত্রছাত্রীর সব সমস্যা সমাধান করতে পারিনি। তবে চেষ্টা করেছি। পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে মনমরা হতাশাগ্রস্থ শিক্ষার্থীকে কিভাবে আবার নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে ভালো করা সম্ভব সে বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছি। কফি-সিঙ্গাড়া খাইয়ে, মন-মানসিকতা বুঝে বন্ধুর মত আচরণ করে তাদেরকে নতুন করে লেখাপড়ায় উদ্বুদ্ধ করেছি। আমার বিশ্বাস, আমার সংস্পর্শে আসা হতাশাগ্রস্থ শিক্ষার্থীরা আমার পরামর্শ শুনে উপকৃত হয়েছেন। আমার সঙ্গ উপভোগ করেছেন।
শিক্ষকতা জীবনে আমি সব সময় ভেবেছি, শিক্ষার্থীরা আছেন বলেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীরাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা যেন উপভোগ্য হয় সেজন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত। এ কারণে আমি শ্রেণিকক্ষের এবং বিভাগের বাইরেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। ক্যাম্পাসের রাস্তায় চলাচল করার সময় পাশের শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমি সব সময় কথা বলেছি। তাদেরকে জানার ও বুঝার চেষ্টা করেছি। সদ্য পরিচিত অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীকে নিজ কক্ষে কফি খেতে ও গল্প করতে ডেকেছি। অনেকে এসেছেন। অনেকে আসেননি। আমি শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিকে কিছুদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসবাস করাকালে ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষক বাসে না চড়ে কাটা পাহাড়ের মনোরম রাস্তা দিয়ে হেটে বিভাগে যাওয়া পছন্দ করতাম। এতে আমার চার-পাঁচ মিনিট হাটা হতো। ভালো লাগতো। এ ক্ষেত্রে আমি দেখতাম, শিক্ষার্থীরা অপরিচিত শিক্ষকের সাথে কথা বলতে চাইতেন না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে সংকোচ ও জড়তা কাজ করতো। সেজন্য আমি সব সময় নিজে যেচে তাদের সঙ্গে আলাপ শুরু করতাম।
আমার আলাপের প্রথম দুটি বাক্য অধিকাংশ সময় এমন হোতো: কেমন আছেন বাবা? আপনি কোন বিভাগে পড়েন? অথবা, কেমন আছেন মামনি? আপনি কোন বিভাগের ছাত্রী? যেহেতু আমি প্রায় প্রতি বিভাগের দু’চারজন শিক্ষককে জানতাম, সেজন্য এমন প্রশ্নের জবাব পেলে তাদেরকে আরও সহজ করে নিতে বলতাম, ওমুক স্যার কি আপনাদের কোনো ক্লাস নেন? উনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এভাবে শিক্ষার্থীকে সহজ করে নিয়ে তার এবং তার বিভাগের খোঁজ খবর নিতাম। কথা বলতে বলতে মিনিট চারেক হেঁটে শহীদ মিনার পর্যন্ত এলে বলতাম, আপনি তো সোজা যাবেন, আমি ডাইনে আমার বিভাগে যাবো। আপনার ক্লাস কখন শুরু হবে? তিনি যদি বলতেন স্যার, আমার ক্লাস শুরু হতে এখনও সময় আছে। আমি সে সুযোগ নিয়ে বলতাম, আপনার আপত্তি না থাকলে আমার সঙ্গে আমার অফিসে আসতে পারেন। আরও কিছুক্ষণ গল্প করে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। এমন প্রস্তাবে অনেকে অবাক হতেন, আসতে চাইতেন না। ধন্যবাদ দিয়ে চলে যেতেন। আবার কেউ কেউ আসতেন। আমি তাদের যত্ন করে রুমে বসিয়ে কফি আর সিঙ্গাড়া খাইয়ে গল্প করে আনন্দ পেতাম। অনেক অজানা তথ্য তাদের কাছ থেকে জানতে পারতাম। এমন প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আমার কাছে একটি না পড়া উপন্যাসের মতো মনে হতো। তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে পারলে এ সব উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ানো তথ্য জানা যেতো।
এলপিআর-এ যাবার পর খুব কম দিনই আমি পার করতে পেরেছি, যে দিন আমার সাথে কোনো বর্তমান বা সাবেক শিক্ষার্থীর কথা হয়নি। নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও আমাকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ফোন করেছেন। আমার লেখালেখির বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। এদের বেশির ভাগই সমাজ বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের শিক্ষার্থী। তবে বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান বা অন্য কোনো অনুষদের শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্যক্রমভুক্ত কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেননি। আমার সে সব বিষয়ে আলোচনার যোগ্যতাও নেই।
একথা ঠিক, আমি আনুষ্ঠানিকভাবে রুটিন অনুযায়ী ক্লাসে যাচ্ছি না। তবে বিশেষ করে রাতের বেলায় হোয়াটসঅ্যাপে এবং মেসেঞ্জারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। প্রশ্নের জবাব জানা না থাকলে ওই বিষয়ে ভালো জানা শিক্ষকের ফোন নম্বর জোগাড় করে দিচ্ছি। আবার সে শিক্ষককে ফোন করে ওই শিক্ষার্থীর নাম বলে তাকে সহায়তা করতে অনুরোধ করছি। এভাবে আমার ভিন্ন রকম শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তবে দিনের বেলায় বৈষয়িক কাজের ব্যস্ততায় কেউ ফোন করলে আমি তাকে সময় দিতে না পারলে রাতে ফোন করতে অনুরোধ করছি। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে যখন রাতে বিদেশ থেকে কোনো শিক্ষার্থী ফোন করে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। বলেন, স্যার আমি আপনাকে অনেক মিস করি। আপনাকে ভুলিনি। তাদের এমন কথায় আমার কন্ঠ ভারি হয়ে যায়। চার দশক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দিয়ে পড়িয়েছি। আমার ধারণা, যারা আমার ক্লাস করেছেন, তারা আমাকে মনে রেখেছেন।
এলপিআর-এ যাবার পর আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন না কেন? কেউ কেউ বাড়িয়ে বলেছেন, আপনি তো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে পারেন। চেষ্টা করছেন না কেন? আমি বলেছি, আমার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই। আমি ভিসি হতে চাই না। তারা অবাক হয়েছেন। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি প্যানেলে নাম দেবার জন্য আমার সিভি চাওয়া হলে আমি রাজি হইনি। বলেছি, এলপিআর-এ থাকাকালীন আমি যে বেতন পাচ্ছি আপনারা তো আমাকে তার চেয়ে খুব বেশি বেতন দিবেন না। হয়তো ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি দিবেন। এর জন্য আমি বাড়তি চাপ নিয়ে রাতের ঘুম নষ্ট করতে চাই না। তারা অবাক হয়ে বলেছেন, আমাদের কাছে ভিসি হতে লোকজন এসে তদবির করছেন, আর আপনি বলা সত্বেও সিভি দিতে চাইছেন না! আমি বলেছি, যারা ভিসি হতে লালায়িত তাদের মধ্যে কারও কারও হয়তো নিয়োগ বাণিজ্য করে বিত্ত বৈভবের মালিক হবার বাসনা থাকতে পারে। আমার তেমন ইচ্ছে নেই। একজনকে বলেছি, ভিসি হবার দরকার নেই, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে যাবো। ক্লাসে একটি লেকচার দেবার সুযোগ দিলে খুশি হব। খুলনায় দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’একটি বিভাগে আমি চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের ওপর শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী লেকচার দেবার আগ্রহ দেখিয়ে সাড়া পাইনি। তারা ভেবেছেন, আমি রাজনীতির শিক্ষক, না জানি কি বলতে কি বলি। সেজন্য আমার অনুরোধ এড়িয়ে তারা ঝুঁকিমুক্ত থেকেছেন।
চার দশক শিক্ষকতা করে নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি। সুস্থ শরীরে চাকুরিজীবন শেষ করতে পারায় মহান আল্লাহ সুবহানাতায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। শিক্ষকতাজীবনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমি যে সমাদর ও সম্মান পেয়েছি তার জন্য আমি তাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। এখনও অবসরজীবনে শিক্ষার্থীরা আমাকে স্মরণ করেন, আমাকে দেখতে আসেন। সেজন্য আমি তাদের কাছে ঋণী। তারা ছিলেন বলেই তো আমি শিক্ষকতা করতে পেরেছিলাম। আমার মনে হয়, আমি এখনও অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকতা করছি। বৈষয়িক ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করছি ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সময় পেলে কথা বলছি। এভাবেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের দোয়ায় সুস্থ শরীরে ব্যস্ততার সাথে সময় কাটাচ্ছি।
আমার সর্বশেষ প্রকাশনা ‘শিক্ষকতা পেশা ব্যতিক্রমী নেশা’(২০২২) বইটি পড়লে শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্বপালন এবং শিক্ষকতা বিষয়ক অন্য বিষয়গুলো আমাকে ভালোভাবে না জানা শিক্ষার্থী ও সম্মানিত পাঠকরা অনুধাবন করতে পারবেন। কাজেই যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমি হয় আনুষ্ঠানিকভাবে না হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকতা করে যাবো। শিক্ষকতা থেকে কখনো অবসর নেব না, যদিও ২৮ তারিখের পর থেকে আমার পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
লেখক : সাবেক সভাপতি ও অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। akhtermy@gmail.com
খুলনা গেজেট/এনএম