খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

অবরোধের প্রথম দিনে ৯ জেলায় সংঘর্ষ, আগুন গুলি নিহত ৩

গেজেট ডেস্ক

বিএনপির ডাকা অবরোধের প্রথম দিন গতকাল মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১২৫ জন। এ নিয়ে গত শনিবার থেকে একজন পুলিশ সদস্যসহ সাতজনের মৃত্যু হলো।

গতকাল মারা যাওয়া তিনজন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মী। বিএনপির দাবি, দুজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। একজন মারা গেছেন পুলিশের গাড়ির ধাক্কায়। অবশ্য পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

নারায়ণগঞ্জে তিন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। একজনের অবস্থা গুরুতর। ঢাকায় হামলায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী, অবরোধ কর্মসূচি পালনের জন্য বিএনপির নেতা–কর্মীরা রাস্তায় নামলে নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ অন্তত ৯টি জায়গায় সংঘর্ষ হয়। এর মধ্যে পাঁচ জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে বিএনপি নেতা–কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের। তিন জায়গায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির এবং এক জায়গায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।

ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি, নারায়ণগঞ্জে দুটি ও কেরানীগঞ্জে একটি বাস পোড়ানো হয়েছে। বগুড়ায় কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের একটি কাভার্ড ভ্যানে পেট্রোল বোমা ছুড়ে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং ভাঙচুর করা হয়েছে বাসসহ ৮ থেকে ১০টি যানবাহন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ৮টি ও ঢাকার সাভারে ২টি বাস ভাঙচুর করা হয়েছে। সিলেটে যাত্রীবাহী বাসে ভাঙচুর করে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। পাবনার ঈশ্বরদীতে ৫টি অটোরিকশাসহ ১৫টি যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সিলেটে খড় জমা করে রেললাইনে আগুন ধরানো হয়েছিল।

রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নেতা–কর্মীরা অবরোধের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল করেন। দুপুরে চানখাঁরপুল এলাকায় বিএনপির মিছিল থেকে হামলায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন।

অবরোধের মধ্যে ঢাকায় যানবাহন চলাচল ছিল কম। দেশের অন্য জেলায়ও ছিল একই চিত্র। সাধারণ মানুষ জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে যাননি। দূরপাল্লার বাস কম ছেড়েছে। ট্রেন চলেছে, তবে যাত্রী কম ছিল। লঞ্চ ছেড়েছে। তাতেও যাত্রী কম ছিল।

নিহত রিফাত, বিল্লাল ও দিলু

অবরোধের প্রথম দিন গতকাল দুজনের মৃত্যু হয়েছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে। নিহত দুই ব্যক্তি হলেন উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি রিফাত উল্লাহ (২২) ও একই ইউনিয়নের কৃষক দলের সভাপতি বিল্লাল মিয়া (২৮)।

বিএনপির দাবি, অবরোধের সমর্থনে সকাল আটটার দিকে ছয়সূতি ইউনিয়ন বিএনপির পক্ষ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যাওয়ামাত্র পুলিশ বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ প্রথমে লাঠিপেটা করে, পরে গুলি ছোড়ে। এতে অনেকে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ রিফাতকে স্বজনেরা জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।

পুলিশের দাবি, মিছিলকারীরা লাঠি ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলার উদ্দেশে এগিয়ে এলে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তারা শর্টগানের গুলি ছোড়ে। কুলিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম মস্তুফা বলেন, ‘আমরা সংখ্যায় ছিলাম ১৫ জন। মিছিলকারীরা আমাদের ওপর হামলা চালাতে এগিয়ে এলে আমরা কিছুটা পিছিয়ে যাই। পরে আত্মরক্ষার জন্য একটি মার্কেটের (বিপণিবিতান) ভেতরে ঢুকে পড়ি। তখন তাঁরা আমাদের ওপর ঢিল ছুড়তে থাকেন। কোনোভাবেই নিজেদের আর রক্ষা করতে পারছিলাম না। শেষে বাধ্য হয়ে শর্টগানের গুলি ছুড়তে হয়।’

পুলিশের দাবি, এ ঘটনায় ওসিসহ সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল মান্নান ও সাকিকুল ইসলাম আহত হয়েছেন। আরও আহত হয়েছেন উপজেলার রামদি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হবি মিয়া।

কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। দুজনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নিহত ব্যক্তিরা পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন কি না, তা নিশ্চিত নয়।

বিএনপির দাবি, তাদের গুলিবিদ্ধ নেতা–কর্মীদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া যায়নি। দূরের হাসপাতাল নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দুজনকে ‘হত্যার’ প্রতিবাদে আজ কিশোরগঞ্জে আধা বেলা হরতাল ডেকেছে দলটি। কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের হয়ে পুলিশ আমাদের দুজনকে হত্যা করল। এরপর একজনের লাশ গুমের চেষ্টা করেছিল।’

নিহত রিফাতের চার মাসের একটি সন্তান রয়েছে। বিল্লাল তিন সন্তানের জনক। দুজনের বাড়িতেই মাতম চলছে। রিফাতের বাড়িতে চার মাস বয়সী মেয়েকে কোলে নিয়ে কাঁদছিলেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের কী হইব। আমার মেয়ে কারে আব্বা ডাকব। আমার মেয়ে এতিম হইয়া গেল।’

নিহত তিনজনের আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে সিলেটে। বিএনপির দাবি, তাঁর নাম দিলু আহমদ জিলু (৪০)। তিনি গোলাপগঞ্জ উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।

সিলেট বিএনপি বলছে, সকালে দলের নেতা–কর্মীরা দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবরোধের সমর্থনে অবস্থান নেন। তখন পুলিশ মারমুখী হয়ে তাঁদের ধাওয়া দেয়। এ পরিস্থিতিতে সবাই দৌড়ে পালাতে থাকেন। দিলু আহমদও তাঁর সঙ্গে থাকা মোটরসাইকেলে করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশের একটি গাড়ি ওই মোটরসাইকেলকে জোরে ধাক্কা দেয়।

বিএনপির অভিযোগ, পুলিশ তাঁদের গাড়িতে করে দিলুকে নিয়ে যায়। পুলিশি হেফাজতে থাকার সময়ও তাঁকে নির্যাতন করা হয়। বিকেলের দিকে দিলুর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

বিএনপির অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছে পুলিশ। দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ওই যুবক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে যায়। পরে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় তাঁকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

এদিকে দিলু আহমদকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে গতকাল বেলা তিনটার দিকে নগরের সোবাহানীঘাট এলাকা থেকে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিল শেষে আজ সিলেট বিভাগের চার জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে সকাল–সন্ধ্যা হরতাল (অবরোধের পাশাপাশি) ডাকা হয়েছে।

ব্যাপক সংঘর্ষ, গুলি

অবরোধে গতকাল কয়েকটি জেলায় বড় সংঘর্ষ হয়। এর একটি নারায়ণগঞ্জ। জেলার আড়াইহাজারে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষের ৩ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচরুখী বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, অবরোধের সমর্থনে গতকাল সকাল সাড়ে আটটার দিকে কয়েক শ নেতা-কর্মী নিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মিছিল করেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক নজরুল ইসলাম। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাঁশের লাঠি হাতে গাছের গুঁড়ি ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ তাঁদের বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, সংঘর্ষের একপর্যায়ে তিনজন পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করা হয়। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন। থানা থেকে আরও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে এলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা চলে যান।

আহত তিন পুলিশ সদস্য হলেন পরিদর্শক হুমায়ুন কবির, সহকারী উপপরিদর্শক মো. মতিন ও কনস্টেবল মো. নুরুল।

নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন বলেন, কনস্টেবল নুরুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। সহকারী উপপরিদর্শক মতিনের ডান হাত কুপিয়ে জখমের পর পিটিয়ে বাঁ হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পরিদর্শক হুমায়ুন কবিরকে লাঠি ও ইটপাটকেল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।

বিএনপি বলছে, পুলিশ বিনা কারণে হামলা করায় সংঘর্ষ বাধে। বিএনপি নেতা নজরুল ইসলামের দাবি, তাঁর বাড়িও ভাঙচুর করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জে কুলিয়ারচর ছাড়াও রাস্তা অবরোধ করা বিএনপির নেতা–কর্মীদের ওপর পুলিশ গুলি করেছে অন্তত দুটি জায়গায়। একটি কিশোরগঞ্জ-ভৈরব আঞ্চলিক মহাসড়কের সদর উপজেলার চৌদ্দশত এলাকা এবং অন্যটি কিশোরগঞ্জে-হোসেনপুর সড়কের কাতিয়ারচর এলাকা।

কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আল আমিন হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, অনেক জায়গায় অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে পুলিশ খবর পাওয়ামাত্রই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি এলাকায় পুলিশ কয়েকটি গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের কয়েকটি শেল নিক্ষেপ করে।

মানিকগঞ্জে বিএনপি নেতা–কর্মীদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ শটগানের গুলি ছুড়ে বিএনপি নেতা–কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন। পুলিশ তিনজনকে আটক করে। মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি আবদুর রউফ সরকার বলেন, পুলিশের ওপর আক্রমণ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হলে শটগানের গুলি ছুড়ে বিএনপি নেতা–কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!