খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

ডুমুরিয়ার নদীতে হাঙর, কুমির, ইলিশ : আমার আশংকা

এ এম কামরুল ইসলাম

পৃথিবী কবে, কখন, কেন সৃষ্টি হয়েছিল এবং কবে ধ্বংস হবে তা নিয়ে বিজ্ঞানিদের কোন সুনির্দিষ্ট মতামত আজো জানা যায়নি। বরং বিভিন্ন সময় বিজ্ঞানিদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে পৃথিবী সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কখন সৃষ্টি হয়েছে তার কোন উল্লেখ নেই। তবে পৃথিবী নিত্য পরিবর্তন হচ্ছে এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। পৃথিবীর পরিবর্তন দেখতে কোন বৈজ্ঞানিক হওয়া লাগে না বা কোন ধর্মগ্রন্থ ঘাটাঘাটি করতে হয় না। অধিকাংশ মানুষ তার চোখের সামনে পৃথিবীর নানাবিধ পরিবর্তন দেখতে পায়। আপনি, আমিও এই জীবনে পৃথিবীর কত পরিবর্তন দেখলাম তা একবার ভেবে দেখুন। আপনার আমার দাদা-দাদী, নানা-নানীর মুখে কত শত পরিবর্তনের কথা শুনেছি তা একবার মনে করে দেখুন। তাহলে বুঝা যাবে পৃথিবী কত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।

আমরা যারা নিজেদের সভ্য ও উন্নত মানুষ হিসেবে দাবি করি, তারা আদিম মানুষের কাছে কতখানি সভ্য হিসেবে গন্য তা একটু ভেবে দেখুন। আবার আদিম মানুষসহ সমগ্র মানবজাতি পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীকুলের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য সেটাও ভেবে দেখা দরকার। মানুষ মনে করে তারা সৃষ্টির সেরা জীব, কিন্তু এমন নাও হতে পারে। মানুষ যেমন সৃষ্টি রহস্য নিয়ে ভাবছে, তেমনি হয়তো অন্যান্য প্রাণীরাও গবেষণা করছে। এমনতো হতে পারে- তারাও তাদের গবেষণার জন্য মানুষের কাছে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ধারণা নেবার চেষ্টা করছে। গেল দুই বছর ধরে ডুমুরিয়ার নদীতে হাঙর, কুমির ও ইলিশ মাছের আগমন তাদের গবেষণার অংশ তো হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে যাবার আগে কিছু আদিম মানুষের ঘটনা বলা দরকার।
আমরা জানি পৃথিবীতে এখনো অনেক আদিম মানুষ বসবাস করে। যাদের মধ্যে পিগমি ও হুতু জাতির কথা অনেকেই জানে। পিগমিদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ আছে বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উঠে এসেছে। তাদের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি আছে। আফ্রিকার কঙ্গো, ক্যামেরুনে তাদের আবাস আছে। অষ্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, এমনকি আমাদের নিকটবর্তী ভারতেও এদের বসবাস আছে।

সেন্টিনেল আইল্যান্ড ভারতের একটি জায়গা। এখানে আদিম মানুষ বসবাস করে। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ শাসন আমলে এই দ্বীপের মানুষদের নিয়ে গবেষণা করা হয়। ইংরেজরা তাদেরকে কৌশলে ধরে এনে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ভারত সরকারও তাদেরকে মানুষের সমাজে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পিগমিরা তাদের বন্য জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে এবং তথাকথিত সভ্য মানুষকে পৃথিবীর শত্রু ভাবে। তারা মনে করে- মানুষ পৃথিবীকে ধ্বংস করছে এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে তথাকথিত সভ্য মানুষ জাতি। তাদের কাছে এ পর্যন্ত যত মানুষ গেছে তাদের অধিকাংশকেই তারা হত্যা করেছে বা হত্যা করতে চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার তাদের স্বকীয়তায় বাঁধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী কী ভাবছে আমরা হয়তো তা অনুমান করতে অক্ষম। তবে পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়নি, আজকাল পরিবেশ বিজ্ঞানীরা তা মর্মে মর্মে বুঝে মানুষ এবং পৃথিবীর প্রয়োজনে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য চিৎকার করছে।

উন্নত দেশের বহু এলাকায় রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় বন্যপ্রাণীরা দল বেঁধে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। মাঝে মাঝে দেখা যায়, রাস্তার দুই ধারে শত শত গাড়ি দাড়িয়ে গেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা ঐসব রাস্তা বন্যপ্রাণীদের দখলে থাকে। এক সময় তারা নিজের ইচ্ছায় রাস্তা ছেড়ে বনে ফিরে যায়। পৃথিবীর সভ্য দেশের মানুষ ঐসব বন্য পশুদের রাস্তা ছাড়তে কখনো বাধ্য করে না। তারা মনে করে, এই জায়গায় তাদেরও অধিকার আছে। বরং মানুষ তাদের জায়গা জবরদখল করে বন্য পশুদের অধিকার খর্ব করেছে।

পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা করে বলেছেন, ভূ-প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বা বিভিন্ন দেশের কিছু কিছু এলাকা সাগরে বিলীন হয়ে যাবে। এই গবেষণার মধ্যে বাংলাদেশের কিছু অংশের কথাও বলা হয়েছে। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, দাকোপ উপজেলা সেই আওতায় পড়ে।

এখন আসি ডুমুরিয়ার নদীতে হাঙর, কুমির ও ইলিশ মাছের আগমন প্রসঙ্গে। আমি একজন কল্পনা বিলাসী পজিটিভ মানুষ। তেমন কোন গবেষণা বা বিজ্ঞানের ধারণা আমার নেই। আমার কল্পনার জগৎ সমগ্র সৃষ্টি নিয়ে। তবে মানুষের কল্যাণ তার মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম। সমগ্র সৃষ্টির প্রতিও আমার কল্পনার জগৎ মাঝে মাঝে ঘুরপাক খায়। তাই ডুমুরিয়ার নদীতে হাঙর, কুমির ও ইলিশ মাছের আগমনের কথা শুনে আমার কল্পনার জগতে কিছু ভাবনার সঞ্চার হয়।

এমনতো হতে পারে- সাগর নদীতে বসবাসরত প্রাণীরা তাদের গবেষণার জন্য মাঝে মাঝে লোকালয়ে প্রতিনিধি প্রেরণ করছে। সেইসব প্রতিনিধিরা কেউ কেউ মানুষের হাতে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ মানুষের অগোচরে তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে গিয়ে তাদের সদর দপ্তরে রিপোর্ট দিচ্ছে। ডুমুরিয়ার নদীতে আসা প্রায় সবগুলো কুমির নিরাপদে ফিরে গেছে, আবার কেউ কেউ মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ফিরে গেছে। হয়তো এমন অনেক কুমির মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে বহুবার এসে নিজ নিজ কাজ সেরে আবার ফিরে গেছে। ইলিশ মাছেরা হয়তো আরো বড় বড় পরীক্ষা বা গবেষণা করেছে। তারা কতদিন মানুষের পুকুরে বাঁচতে পারে সেটা পরীক্ষা করেছে। হয়তো তাদের গ্রুপে আরো অনেকেই ছিল। তারা ফিরে গিয়ে তাদের সদর দপ্তরে রিপোর্ট দিয়েছে এবং কিছু ইলিশ গবেষণার স্বার্থে তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে। একটা হাঙর মানুষের হাতে ধরা পড়ে তার জীবন দিয়েছে। হয়তো তার মতো আরো হাঙর মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে কর্মসিদ্ধি করে ফিরে গেছে।

আমরা UFO অর্থাৎ Unidentified Flying Objects এর কথা শুনেছি। যাকে কেউ কেউ উড়ন্ত শসার বলে থাকে। মানুষের জন্য এটাও একটা চিন্তার বিষয়। অনেক বিজ্ঞানি মনে করেন, UFO ভিন্ন কোন গ্রহ বা এলাকা থেকে পাঠানো হয়, যারা মানুষের চেয়ে উন্নত। আবার মানুষ মনে করে- পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণীর চেয়ে মানুষ সেরা। এমন পরস্পর বিরোধী চিন্তা সকল সৃষ্টির মধ্যে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

হয়তো হাঙর, কুমির, ইলিশ মাছের ধারণা- মানুষেরা তাদের পূর্ব পুরুষের জায়গা দখল করে আছে। কারণ আমরা আমাদের দাদা-দাদী, নানা-নানীর কাছে শুনেছি, আমাদের এলাকায় একদিন বড় বড় নদী ও বনজঙ্গল ছিল। সেইসব নদীতে প্রচুর হাঙর, কুমির, ইলিশ মাছ পাওয়া যেতো এবং জঙ্গলে বাঘ, ভালুক, হরিণ ছিল। যেটুকু জলাশয় ছিল সেখানে প্রচুর পাতিবন, হোগলাবন, বাজুয়া ঘাস জন্মাতো। তাইতো এখানে অনেক গ্রামের নাম পাতিবুনিয়া, হোগলাডাঙ্গা,বাজুয়া ইত্যাদি।

এখন আমার কল্পনার জগতে যদি ধরে নেই, নদীর পানিতে বসবাসরত সেইসব হাঙর, কুমির, ইলিশ মাছেরা তাদের হারানো জলাশয় পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিনিধি পাঠিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে, তাহলে কি খুব অমূলক হবে?

আমার ধারণা ভুল হোক এই কামনা করি।

এমনিতেই সমগ্র বাংলাদেশের লোকসংখ্যা বেড়ে দেশটা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তারপর সমুদ্রগর্ভে বিশাল এলাকা তলিয়ে গেলে এলাকার মানুষ আরো অসহায় হয়ে পড়বে। তাই বলে মানুষ যথেচ্ছাচারী হলে প্রকৃতি কখনো ক্ষমা করবে না, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিবেই নিবে। সুতরাং মানুষকে এখনই সচেতন হতে হবে। নির্বিচারে প্রকৃতিকে হত্যা না করে, তাদের কথা মাথায় রেখে সকল প্রাণী ও ভূ-প্রকৃতি রক্ষায় মানুষকেই চিন্তাভাবনা করতে হবে; যেমনটি করে থাকে উন্নত দেশের মানুষ। তারা অহেতুক বৃক্ষ নিধন করে না, তারা বন্য পশুপাখিদের হত্যা করে না, তারা পরিবেশ সংরক্ষণ করে, তারা সাগর-নদী, জলাশয় দুষিত করে না। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে- পৃথিবী শুধু মানুষের একার জন্য সৃষ্টি হয়নি, বরং পৃথিবী নামক গ্রহটিতে সকল সৃষ্টির সমান অধিকার আছে।

আমরা হয়তো মনে করছি- এসব হতে এখনো অনেক দেরি আছে। কিয়ামতের এখনো অনেক বাকী আছে। অথবা বলছি- আল্লাহর জিনিস আল্লাহ রক্ষা করবে। আমাদের এসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমি আর কয়দিন বাঁচবো। এতকিছু ভেবে আমার কি লাভ?

কিন্তু, আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, আমাদের সন্তানের কথা বা সন্তানদের সন্তান, তার সন্তানের কথা? হ্যা, আমাদের ভাবতেই হবে। যে দেশের মানুষ যত বেশি ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করবে সে দেশ তত বেশি সুফল পাবে এবং বেশিদিন টিকে থাকবে। আর যে দেশের মানুষ প্রকৃতির উপর যথেচ্ছাচার করবে, সে দেশ তত দ্রুত ধ্বংস হবে। আল্লাহ কোথাও বলেননি, তিনি সবাইকে সমানভাবে ক্ষমা করবেন। বরং পবিত্র কোরানে তিনি বার বার মানুষকে হুশিয়ার করেছেন। এমনকি অনেক উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ আল্লাহর হুশিয়ারী অমান্য করে মুখে আল্লাহর নাম নিয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে পুরোদস্তুর অপব্যবহার করছে।

তাই বলি- আসুন, আমরা আমাদের স্বার্থে পরিবেশ রক্ষা করি। অহেতুক বৃক্ষ নিধন না করে, বৃক্ষ রোপন ও সংরক্ষণ করি। যেটুকু নদী এখনো অবশিষ্ট আছে তা বাঁচিয়ে রেখে জলজ প্রাণীর জীবন ঝুঁকিমুক্ত করি। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সচেতন হই। নইলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।

লস এঞ্জেলস

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!