খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

প্রাকৃতিক দূর্যোগ : কেন ও তা প্রতিকারের ইসলামি উপায়

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী

বাংলাদেশে প্রায়ই হানা দেয় সাইক্লোন ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ। কিছু দিন আগে হয়ে গেল প্রলয়ংকারী ঝড় বুলবুল, ফনি; যার আঘাতে লন্ড-ভন্ড হয়েছিল ঘর-বাড়ি, থমকে গিয়েছিল মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। অবার নাকি সামনে আসছে ধ্বংসাত্বক ঝড় ’গতি’। এ সমস্ত প্রাকৃতিক দূর্যোগের শুধুমাত্র বাহ্যিক কারণ গুলো আমরা দেখি; যেগুলো মূলত কারণ নয়, কারণের ফলাফল প্রকাশের মাধ্যম।

এর মূল কারণ তাহলে কি? বিষয়টির একটি উপমা দিলে বুঝতে সহজ হবে। মানুষের বাড়ির মালিক ছাদের ওপর থেকে একটি অবাধ্য ও পাগলা কুকুরকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ে মারলো। উদ্দেশ্য কুকুরটাকে কিছুটা সায়েস্তা করা। ঢিলটি কুকুরের গায়ে লেগে দূরে ছিটকে পড়লো। এতে অবোধ কুকুরটি মনে করলো, এই ঢিলটিই তাকে আঘাত করেছে। এইজন্য সে ঢিলটির দিকে দ্রুত ছুটে গিয়ে সেটাকে উপর্যপরি কামড়াতে শুরু করলো। সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হলো, কুকুরের মাথায় এতটুকু বুদ্ধি নেই যে, সে বুঝতে পারবে, ঢিল তাকে আঘাত করেনি; বরং আঘাত করেছে তার মালিক। আমাদের ব্যপারও অনেকটা অনুরূপ।

কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ আসলেই তার কারণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমরা মনে করি, ঝড়-ঝাপটা, হারিকেন-সাইক্লোনই আমাদের আঘাত করেছে। কিন্ত এটা আমরা অনুধাবণ করতে পারি না যে, যা এসেছে সবকিছু মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ’র প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষ হুকুম, আদেশ বা ইশারাতে হয়েছে। আর এটা আন্দাজ করা মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। এই কারণেই আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি-রহস্যের নিঁখুত জ্ঞান দিয়ে নবী-রসুলদেরকে প্রেরণ করেছেন।

কোরআন ও হাদিসের অগাধ জ্ঞানভান্ডার থেকে জানা যায়, আসমান ও জমিনে যা কিছু বিপর্যয় ঘটে তা মানুষের দুই হাতের কামায়। অর্থাৎ আমরা যেমন কর্ম করবো তেমন ফল পাবো। সাধারণত কয়েকটি কারণে আল্লাহপাক আজাব বা বিপর্যয় পাঠান। অবাধ্যকে শাস্তি দেবার জন্য, গোনাহগারদের সতর্ক করার জন্য, মুমিনের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য অথবা মুমিদেরকে পরীক্ষার জন্য।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন: তোমাদের ওপর যে বিপদ-আপদ পতিত হয় তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন (সূরা শু’রা: ৩০)। জলে-স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তাদেরকে কৃত-কর্মের (কিছুটা) শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে (সূরা রুম: ৪১)। কখনও কখনও মুমিন বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে থাকেন। এ ব্যপারে আল্লাহপাক বলেন: অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছুটা, ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষয়-ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে তাদের সুসংবাদ দাও যারা ধৈর্য্য ধারণ করবে। যখন তারা বিপদে পড়ে তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লা’র জন্য এবং আল্লা’র কাছেই ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লা’র অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত (সূরা বাকারা: ১৫৫-১৫৭)।

আসমান-জমিন, আকাশ-বাতাস, নভোমন্ডল-ভূমন্ডলে যা কিছু আছে; আমরা দেখি বা না দেখি, আন্দাজ করতে পারি বা না পারি; সবই মহান আল্লাহতায়ালার মাখলুক বা সৃষ্টি। অনু-পরমাণু থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির ওপরেই তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সবই আল্লা’র সৈন্য বাহিনী। আল্লাহপাকই ভালো জানেন কখন কোন সৈন্য কার বিরুদ্ধে লাগাবেন। ইতিহাসে এর ভূরিভূরি প্রমান আছে। বাতাস ও পানি আমাদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় দুটি বস্তু; কিন্তু এই বাতাস, পানি ও ঝড়-ঝঞ্জা দিয়েই আল্লাহতায়ালা আদ জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। নুহ (আ.)-এর জাতিকে আল্লাহতায়ালা বন্যা-তুফান দিয়ে নাস্তা-নাবুদ করে দিয়েছিলেন। সমকামিতার কারণে লুত (আ.)-এর জাতিকে একইভাবে মহা দূর্যোগ দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন (বিস্তারিত দেখুন সূরা ক্বমার: ৯-২১, সূরা ফুচ্ছিলাত: ১৫, সূরা আহক্বফ: ২০-২৫, সূরা নামল: ৫৪-৫৮) ।

মোট কথা, আমাদের নানাবিধ খারাপ আমলের কারণে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয় দেখা যায়। একটি হাদিসে এ বিষয়টি পরিস্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (স.) এরশাদ করেছেন: যখন মানুষ গনীমতের মালকে ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করতে আরম্ভ করবে, আমানতকে (জনগণের মাল, সরকারী সম্পতিও এর মধ্যে শামিল) গনিমতের মাল মনে করতে শুরু করবে (অর্থাৎ আমানতকে আদায় করার পরিবর্তে নিজে খরচ করে ফেলবে), জাকাতকে জরিমানা মনে করতে আরম্ভ করবে (অর্থাৎ খুশী মনে দেবার পরিবর্তে অসন্তুষ্টির সাথে দিবে), এলেম দ্বীনের উদ্দেশ্যে নয় বরং দুনিয়ার জন্য অর্জন করতে শুরু করবে, মানুষ স্ত্রীর আনুগত্য করবে ও মায়ের অবাধ্যতা করতে শুরু করবে, বন্ধু বান্ধবকে নিকটে করবে ও বাপকে দূরে সরায়ে দিবে, মসজিদের মধ্যে প্রকাশ্যে শোরগোল করা আরম্ভ হবে, ফাসেক বা গোনাহগার লোক জাতির নেতৃত্ব দিতে শুরু করবে, জাতির নেতারা জাতির নিকৃষ্টতম লোক হবে, কারও অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য মানুষ তার সম্মান করবে, গায়িকা নারীদের এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক প্রচলন হবে, ব্যাপকভাবে শরাব (মদ বা নেশা জাতীয় পানীয় ইত্যাদি) পান করা হবে এবং উম্মতের পরবর্তি লোকেরা তাদের পূর্ববর্তি লোকদেরকে মন্দ বলা শুরু করবে, এমন সময় অপেক্ষা করো লালবর্ণের ঝড়, ভূমিকম্প, ভূমি ধ্বস, মানুষের চেহারা বিকৃতি হওয়া এবং আকাশ থেকে পাথর (বা পাথরের মতো বৃষ্টি) বর্ষিত হওয়ার। আর এমন বিপদ আপদের জন্য অপেক্ষা করো, যেমন মালার সুতা ছিড়ে গেলে তার মুক্তাদানা গুলো একের পর এক দ্রুত পড়তে থাকে (তিরমিজি)।

আল্লাহপাক তার পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন: তারা যতোক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে আল্লাহ কখনও তাদের ওপর আজাব দিবেন না ( সূরা আনফাল: ৩৩)। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, যখনই ঘূর্ণিঝড় বা কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিতো, তখন সাথে সাথেই মহানবী (স.) মসজিদে যেতেন এবং নামাজে মনোনিবেশ করতেন। তাই আমাদেরও উচিত আমাদের আমল বা কর্ম সংশোধন করা। তওবা-এস্তেগফার, নামাজ-রোযা, দান-সদকা, দোয়া, ধৈর্য্যে ও পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগের উত্তরণ করাই কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা।

 

(লেখক : অধ্যাপক, ফিসারিজ ডিসিপ্নিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

 

খুলনা গেজেট / এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!