খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ মাঘ, ১৪৩১ | ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট জারি: আইন উপদেষ্টা
  ন্যূনতম সংস্কার শেষে নির্বাচন চাই : ফখরুল

ফাঁস হওয়া প্রশ্নে তৈরি হয়েছে ৫ হাজার চিকিৎসক

গেজেট ডেস্ক

২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অন্তত ১০ বার মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। এসব প্রশ্নে পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন। এরই মধ্যে বেশিরভাগেই চিকিৎসক হয়েছেন। অনেকে রোগীও দেখেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে চিকিৎসক হওয়া ব্যক্তিদেরও তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

প্রশ্নফাঁসের এক পুরোনো মামলায় সম্প্রতি সাত চিকিৎসকসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তারের পর আবার মেডিকেল কলেজের প্রশ্নফাঁস চক্রের বিষয়টি সামনে আসে। ওই ঘটনায় করা মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক বছর থেকেই তারা মামলাগুলো নিবিড়ভাবে তদন্ত করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় কয়েকজন চিকিৎসক গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সিআইডির সাইবার বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে  বলেন, ২০২০ সালে প্রশ্নফাঁসের একটি মামলায় শুরুতে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এবার ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রথম দফায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে চক্রের মাস্টারমাইন্ড সালাম ও জসিমের পরিবারের সদস্যরা ছিল। এবার গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে চিকিৎসক রয়েছেন ৭ জন। আরও ১৫ চিকিৎসককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সিআইডির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুরো চক্রে কমপক্ষে ৮০ জন সক্রিয় সদস্য থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ২৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা প্রশ্ন কেনা চক্রের বিষয়েও তথ্য পেয়েছেন। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত তদন্তেও অনেকের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অন্তত ৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা এখন পর্যন্ত যে ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছি, তাদের কাছ থেকে এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।

গ্রেপ্তার সেই ৭ চিকিৎসক যারা:

প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ৭ চিকিৎসকসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির সাইবার ইউনিট। ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও বরিশালে এ অভিযান চালানো হয়।

চিকিৎসকরা হলেন—ফেইম কোচিং সেন্টারের ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান, ময়েজের স্ত্রী জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক সোহেলী জামান, প্রাইম কোচিং সেন্টারের ডা. মো. আবু রায়হান, থ্রি ডক্টরস কোচিংয়ের ডা. জেড এম সালেহীন শোভন, মেডিকো কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. মো. জোবাইদুর রহমান জনি, জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসক জিল্লুর হাসান রনি ও ময়মনসিংহের বেসরকারি কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল।

অন্য ৫ জন হলেন—চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসিমের বড় ভাই ও স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের সাবেক মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার, জসিমের ঘনিষ্ঠ সহচর রওশন আলী হিমু, ই-হক কোচিংয়ের আক্তারুজ্জামান তুষার, ফার্মগেটের ইউনিভার্সাল নামে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্রের মালিক জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী এবং টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস সরকার।

সিআইডির একটি সূত্র জানায়, চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহমেদ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে পরে ফেইম কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়ান। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তিনি অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়েছেন।  তার স্ত্রী সোহেলীও এই চক্রের সদস্য। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ময়েজের সঙ্গে প্রশ্নফাঁস চক্রে যুক্ত হন। গ্রেপ্তার জেড এম সালেহীন শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক জোবাইদুর রহমান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন।

প্রশ্ন বের করতেন সালাম, বিক্রিতে জসিম:

মেডিকেলের প্রশ্নফাঁসের মূল মাস্টারমাইন্ড জসিম উদ্দিন ভূইয়া মুন্নু। তাকে প্রশ্নপত্র বের করে দিতেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরোর প্রেসের মেশিনম্যান আব্দুস সালাম। প্রশ্ন পাওয়ার পর সারা দেশে থাকা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রির কাজটি করতেন জসিম। সালাম-জসিমের সিন্ডিকেটে তাদের পরিবারের সদস্যরাও জড়ায়। সঙ্গে যুক্ত হয় মেডিকেলে ভর্তি কোচিংয়ের মালিক ও শিক্ষকরা। তাদের মাধ্যমেই সারা দেশে প্রশ্ন বিক্রি করে আসছিল চক্রটি।

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হতো একেকটি প্রশ্ন। কোচিংগুলোকে সম্পৃক্ত করার পর থেকে প্রশ্নপত্র বিক্রি বহুলাংশে বেড়ে যায়। গত ১৭ বছরে কোটি কোটি টাকার প্রশ্নপত্র বিক্রি করেছে চক্রটি। জড়িতদের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে ৫ জনের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

সিআইডি সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০১৫ সালে মেডিকেল ও ২০১৭ সালে ডেন্টালের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এরপর আর প্রশ্নফাঁস করতে পারেনি এই চক্রটি। ২০১১, ২০১৫ ও ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হন জসিম। জামিনে ছাড়া পেয়ে একই অপরাধে জড়ান তিনি। একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন জসিম। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জসিমের সম্পদ ফুলে ফেঁপে ওঠে প্রশ্নফাঁস শুরুর পর থেকে। ঢাকার একাধিক এলাকায় বাড়ি, গার্মেন্টস, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী পাঠানোর কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। একইভাবে চক্রের অন্য সদস্যদের প্রশ্নপত্র বিক্রি করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পেয়েছে সিআইডি।

যেভাবে চক্রের সন্ধান:

২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস নিয়ে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। এ ঘটনায় করা মামলায় ১২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় সংস্থাটি। এই ১২৫ জনের মধ্যে চার্জশিট দেওয়ার আগে ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় তারা। তাদের মধ্যে ৪৬ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

সিআইডি জানিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের মামলা তদন্তকালে ২০১৮ সালে একটি চক্রের সন্ধান পায় তারা। ২০২০ সালের জুলাইয়ে এস এম সানোয়ার হোসেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যে সিআইডি প্রথমবার জানতে পারে, ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৭ সালের মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তার দেওয়া তথ্যেই গ্রেপ্তার হয় মাস্টারমাইন্ড জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু। এরপর একের পর এক জড়িতদের নাম বেরিয়ে আসে। ২০২০ সালেই ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সিআইডির সাইবার ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশ্নফাঁসের টাকা বিদেশে পাচারেরও তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে একটি মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে। নতুন করে যাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধেও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে।

সিআইডি প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি নিয়ে জিরো টলারেন্স থাকার নির্দেশনা রয়েছে। এর সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

গতকাল রোববার রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তর সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, এই চক্র ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার প্রশ্নফাঁস করেছে। এই চিকিৎসকরা সবাই বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের সঙ্গে মালিকানায় বা অন্যান্যভাবে জড়িত আছে। গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অবিভাবকদের দেওয়া বিপুলসংখ্যক ব্যাংক চেক, এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, উদ্ধার আলামতের মধ্যে মোবাইল ফোন ১৯টি, ল্যাপটপ চারটি, নগদ টাকা ২ লাখ ১১ হাজার, ১৫ হাজার ১০০ থাই বাথ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ১৫টি ও ভর্তির অ্যাডমিট কার্ড জব্দ করা হয়েছে।

 

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!