দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী ২০২৪ সালে শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতিতে সে বিষয়টির জানান দিয়ে চলেছেন। একইসঙ্গে চলছে দলটির সাংগঠনিক প্রস্তুতি।
নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে বিভেদ আর মতানৈক্য দূরীকরণে বিচ্ছিন্নভাবে বৈঠক, সাংগঠনিক সফর, সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হালনাগাদসহ এক গুচ্ছ কর্মকাণ্ড নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।
এ-তো গেল ক্ষমতাসীন দলটির সাংগঠনিক তৎপরতার খবর। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে সবচেয়ে বড় হয়ে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো- নির্বাচন যথাযথভাবে এবং ঝামেলামুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে হবে তো?
কেননা দেশের অন্যতম বড় দল হিসেবে বিবেচিত বিএনপি বলছে, নিরপেক্ষ সরকার তারা ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না। এমনকি এই দাবি পূরণ ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।
অপরদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, সাংবিধানিক পদ্ধতিতে যথাসময়ে অর্থাৎ বিদ্যামান ব্যবস্থায় নির্বাচন হবে। তাতে কেউ অংশগ্রহণ করুক আর না করুক।
কিন্তু সরকারের এই ভাষ্যের সঙ্গে দেশ-বিদেশে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দেশের অভ্যন্তরেও কিছু শক্তির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- তারা অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। সরকার এবং আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল অনেকের বক্তব্যেও এটা স্পষ্ট যে, তারা এ ধরনের চাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন।
বিএনপি নির্বাচনে আসুক- এটা সরকার তথা আওয়ামী লীগও গভীরভাবে চাচ্ছে। আর বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে গত এক বছর ধরেই তারা নানা কৌশলও আঁটছে।
একইসঙ্গে তারা বলছে, কেউ না এলেও বিদ্যমান ব্যবস্থায়ই জাতীয় নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ একাধিকবার তা প্রকাশ্য বক্তব্যেই বলেছেন।
সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।‘ ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।’
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালন করবে। এ সময় সরকারের পরিসর ছোট করা হবে। সরকার নির্বাচনের সময় শুধু রুটিন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে না। সংবিধান অনুযায়ী সহায়ক সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন বা নির্বাচনকালীন সরকার বলে কোনো ধরনের সরকার গঠন করার বিধান নেই।
এদিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এবং নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, পদায়নসহ কিছু কিছু কাজে সরকারকে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিতে হয়।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহ দীন মালিক বলেন, ‘সংবিধানে বা আইনে এই বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। বলা হয়েছে, নির্বাচন পরিচালনা কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে, সরকার তার রুটিন দায়িত্ব পালন করবে।’
এ বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগেই বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে এক ধরনের দৃশ্যমান কৌশল দেখা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আসনের উপনির্বাচনে দলত্যাগী বিএনপি নেতা উকিল আব্দুস সাত্তার বিজয়ী হন।
এরপর সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলতে থাকেন, এমন একশত আব্দুস সাত্তার নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত আছেন। রাজনৈতিক মহলে এমন কথাও ছড়িয়ে পড়ে যে, বিএনপির একাংশকে নির্বাচনে আনার জন্য সরকার কাজ করছে।
কিন্তু এরপরও বিএনপি বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন না করতে অনঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে। মাঝে আলোচনায় আসে সংলাপও। কূটনীতিকদের মাধ্যমে দলগুলোর মধ্যে বার্তা চালাচালিও হয়। কিন্তু দশ্যত ফলাফল এখনও শূন্য।
এদিকে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় সৃষ্টিকারীদের ভিসা দেবে না তারা। তার অল্প কিছুদিন পরই পাঁচ সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেটাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন সরকারের কৌশল।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সুবিধাভোগী এবং নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের অনেকেরই পরিবার-পরিজন এবং স্বজনরা আমেরিকায় আছেন। ভিসা না পাওয়ার ভয়ে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনে সহযোগিতা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে কী হয়, সরকার কী কৌশল নেয়- সেটাই এখন দেখার বিষয়।’
তবে এ কৌশলের কথা বলতে পারছেন না কেউই। খোদ আওয়ামী লীগের নেতারাও এ বিষয়ে কিছু জানেন না। এ নিয়ে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্য এবং সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের সঙ্গে কথা বললেও তারা কিছু বলতে পারেননি।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘সরকার যথানিয়মে যথাসময়ে নির্বাচন করবে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। জনগণ যাকে ভোট দেবে তারাই সরকার গঠন করবে।’
রাজনৈতিক গবেষক, লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পুরনো কৌশলের তো পুনরাবৃত্তি হবে না। এবার আওয়ামী লীগের কৌশল সম্ভবত আওয়ামী লীগও জানে না। জানেন শুধু দলীয় প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দলের তিনিই ডিফেন্ডার, তিনিই গোলরক্ষক, তিনিই স্ট্রাইকার। প্রতিপক্ষের জালে বল ঢোকাতে তিনি মরিয়া। দেশের রাজনীতির ময়দানে তার মতো কুশলী স্ট্রাইকার আর কে আছে?
‘রাজনীতি ফুটবল খেলার মতোই। এখানে বলের দখল নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, ফাউল প্লে হয়, মারামারি হয়, হাত দিয়ে বল ছুঁয়ে গোলে পাঠালেও তা অসিদ্ধ হয় না। জেতাটাই আসল কথা। এটা সত্যযুগ নয় যে নীতিশাস্ত্র মানতে হবে।’
খুলনা গেজেট /কেডি