আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৎপরতা বাড়ছে বিদেশি কূটনীতিকদের। তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়েও মতবিনিময় করছেন। এসব বৈঠকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে শক্তিশালী দেশগুলো বিভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে-অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ভোটকে কেন্দ্র করে সহিংসতা প্রতিরোধ, বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ, নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক পাঠানো এবং ভোটের ফলাফল মেনে নেওয়াসহ নির্বাচনসংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যু।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠক নতুন কিছু নয়। বিগত সংসদীয় নির্বাচনগুলোর আগেও একই ধরনের বৈঠক হয়েছে। অনেক সময় বিদেশিদের বাংলাদেশে এসে দূতিয়ালি করতেও দেখা গেছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ২২ মার্চ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে তার গুলশানের বাসভবনে বৈঠক করে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহম্মেদ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ এবং কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি নেতারাও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে বৈঠক করেছেন। ১৬ এপ্রিল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধি দল গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদও উপস্থিত ছিলেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ১০ এপ্রিল ওয়াশিংটনে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার তাগিদ দিয়েছেন ব্লিংকেন। মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রতি গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে।’ বাংলাদেশ সরকারের তরফে জানানো হয় যে, নির্বাচন হবে সংবিধানের আওতায়। যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করলে ভোটে পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি ১৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। হোয়াইটলি ১৮ এপ্রিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আওয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয়।
আমেরিকা ও ইউরোপের পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা নির্বাচন নিয়ে বেশি সরব থাকলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তৎপরতা কৌশলগত কারণে তেমন দৃশ্যমান নয়। চীন মনে করে, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারত বরাবরই শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকার কথা বলে আসছে। তবে তারাও নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে। জাপান অনেকটা মার্কিন স্টাইলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। রাশিয়া বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাকে বাড়াবাড়ি বলে মনে করে। নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা আরও বাড়তে পারে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিদেশিদের ঢুকতে দেয় না। ট্রাম্পের ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ক্যাপিটাল হিলে মারা হলেও তা নিয়ে কোনো কথা নেই। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা। আশা করি, বিএনপি মাথা ঠান্ডা করে নির্বাচনে অংশ নিলে দেশের জন্য সহায়ক হবে।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয় তার সবই বিদেশিরা বলে দিচ্ছেন। নির্বাচন, মানবাধিকার, আইনের শাসন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, গুম, খুন, কার্টুনিস্ট হত্যা, সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার ওপর দমন-পীড়ন এসবই আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় সরকার খুব সমালোচনা করে। কারণ তাদের পক্ষে বলার কোনো লোক নেই।’
বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে কিনা জানতে চাইলে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো আলাদা কোনো লোকের কাছে যাই না। সরকার যাদের কাছে যায় আমরাও তাদের কাছে যাই। আমরা যদি ধরনা দেই তবে তাদেরটা কোন সংজ্ঞায় ফেলবেন?’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক হিসাবে আমি বিদেশি কূটনীতিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এটা আমার পদের জন্যে দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমার সঙ্গে আলোচনা মূলত সৌজন্যমূলক। যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা আমাদের কাজ। তবে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা ধরনা দেওয়ার রাজনীতি করে না।’
শাম্মী আহমেদ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের একটা পক্ষ (বিএনপি) বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়। নালিশ করে। তখন স্বাভাবিকভাবে আমাদের সঙ্গে দেখা হলে বিদেশি কূটনীতিকরা রাজনীতি, নির্বাচন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তখন আমাদেরও তার জবাব দিতে হয়। তবে আমি এও মনে করি, আমাদের রাজনীতিবিদদের এমন কিছু করা উচিত না যাতে আমাদের মান-সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।’
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা নতুন কিছু নয়। ১৯৯৬ সালে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন দৌড়ঝাঁপ করেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেস তারানকো। তিনি রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংকট নিরসনে চেষ্টা চালান।
প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানান।