প্রায় ৩৫ বছর আগে খুলনার উপকূলীয় এলাকা কয়রা থেকে সব হারিয়ে বাবা আলী আহমেদ গাজী এসেছিলেন মহানগরী খুলনার বাস্তুহারা কলোনীতে। তাদের দুই ভাই ও এক বোনের জন্ম ও বেড়ে উঠা এখানেই। শরীফা খাতুনরা (২৩) এখন ১২ নম্বর সড়কের বাসিন্দা। খুলনা সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শরীফা খাতুন বলেন, ‘এই কলোনীতে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, পয়নিস্কাশন ও জলাবদ্ধতা ছিল নিত্য সঙ্গী। তবে এ বছরটা কিছুটা ভাল। আগে কলোনীর লোকজনকে এক সাথে কিছু করতো না। এখন বাসার সামনে থেকে করপোরেশন ময়লা নিয়ে যায়। ড্রেন, নর্দমায় ময়লা ফেলা কমেছে। কিছু পানির লাইনও পেয়েছি। কিন্তু পুরো সমস্যা কাটতে আরো সময় লাগবে।
দেশের অন্যান্য শহরগুলোর ন্যায় খুলনা মহানগরীর বিশেষ করে বস্তি এলাকায় সুপেয় পানি এবং বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার সংকট বাড়ছে। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম চিত্র সিটির ৫ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। ওই দুটি ওয়ার্ডে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে নেওয়া বিশেষ প্রকল্প এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। ধীরে ধীরে সকল ওয়ার্ডে এধরণের প্রকল্প নেওয়া হবে বলে কেসিসি’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বস্তি শুমারি (২০১৪) তথ্য অনুযায়ী, খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) এলাকায় বস্তির সংখ্যা এক হাজার ১৩৬টি। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। বিশেষ করে রেলের জমিতে নতুন বস্তি গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সংগঠনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, খুলনায় নিম্ন আয়ের ৮২ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি, ৯১ শতাংশ পরিবার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেবা থেকে বঞ্চিত এবং ৫৯ শতাংশ পরিবারের পয়ঃনিস্কাশন অস্বাস্থ্যকর ও ৩৮ শতাংশ পরিবারের টয়লেট নর্দমার সাথে সংযুক্ত। জরিপে সমস্যা নিরসনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে ঘরে পানি সংযোগ প্রদান, পানির এটিএম বুথ স্থাপন, নিয়মিত পানি পরীক্ষা, স্থানীয়ভাবে মনিটরিং কমিটি গঠন ও আইনগত পদ্ধতি সহজ করা, বস্তি এলাকায় ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন স্থাপন, বর্জ্যকে পরিবেশ বান্ধব ও সম্পদে পরিণত করা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করা এবং নিস্কাশন ব্যবস্থায় সকল ড্রেন সচল করা, সকল খাল, নদী, ড্রেন থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রেশমা আক্তার (৪৮) বলেন, আমাদের আগে রাস্তায় পানি উঠতো। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলতো। এখন আমরাই সেগুলো পরিস্কার করছি। তবে এখনও পানি, ডাস্টবিন সমস্যা রয়েছে। কাউন্সিলর, সিটি করপোরেশন বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে দেখছে।
নাগরিক কমিটি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা সিটি করপোরেশন, খুলনা উন্নয়ন কতৃপক্ষ, ওয়াসা ও পরিবেশ দপ্তরের কাছে তুলে ধরেছে উল্লেখ করেন নাগরিক কমিটির সভাপতি মিনা আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। অন্যগুলো পুরণে আইনগত বা কারিগরি সমস্যা রয়েছে- তা সমাধানে আশ্বাস্ত করেছেন। আশাকরি এগুলো বাস্তবায়ন হলে নিম্ন আয়ের মানুষদের কষ্ট লাঘব হবে।
সচেতনামূলক কাজে সম্পৃক্ত উন্নয়নকর্মী মো. শাহীন বলেন, কেসিসির সহায়তায় নগরীর ৫ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে সচেতনামূলক কিছু কাজে আমরা সহায়তা দিয়েছি। এতে মানুষের মধ্যে সচেতনা বেড়েছে। তারা নিজেদের কাজ নিজেরাই করছেন। অন্যান্য ওয়ার্ডে একইধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হলে বস্তিবাসিরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।
কেসিসি’র কনঞ্জারভেন্সী কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ বলেন, নগরীতে প্রতিদিন প্রায় চার’শ টন বর্জ্য হয়। অনেকের অসচেতনার কারণে সেগুলি ড্রেন বা যত্রযত্র ফেলছে। করপোরেশ সাধ্যমত এ বিষয়ে কাজ করছে। ইতিমধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থপনা প্রকল্পের কাজ চলছে। বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করা হবে। এ থেকে জ্বালানি, সার উৎপাদন হবে। এ জন্য সকলকে সহযোগিতা করতে হবে।
৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমার এলাকাটিতে অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। নিয়মিত তাদের সাথে কাজ করছি। সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে অনেক কাজ সম্ভব নয়। তাই নাগরিক অংশগ্রহণ জরুরী। অন্য এলাকার থেকে এখানকার মানুষের সচেতনতা বেড়েছে।
খুলনার মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, পানি সংকট নিরসন ও সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বিষয়ে নগরীর ৫ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডকে মডেল হিসেবে গড়তে তুলতে বেশকিছু কাজ হয়েছে। শুধু দু’টি নয়, খুলনার ৩১টি ওয়ার্ডকে মডেল করতে চাই। এ জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। নাগরিক সমস্যা নিয়ে কিছু সুপারিশ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। চলমান প্রকল্পে কাজ শেষ হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
খুলনা গেজেট/কেডি