সন্ধ্যায় নতুন চাঁদ উঠছে। ইতোমধ্যে সবাই প্রথম তারাবিহ আদায় করে ঘরে ফিরেছেন। কাল (শুক্রবার) থেকে সিয়াম সাধনা শুরু।পবিত্র রমজানে সারাদিন না খেয়ে সংযম, পবিত্রতা অর্জন, ত্যাগ কতোকিছুই আমরা করি। এই ত্যাগ যেন শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে-সেই অনুরোধ জানিয়ে এই লেখা।
সব সময় দেখা যায়, রোজার এই ‘ত্যাগ’ ফজরের পর থেকে শুরু হয়ে ইফতারের আগ পর্যন্ত বহাল থাকে। মাগরিবের আযান দেওয়ার পর ত্যাগটা পরিণত হয় ‘ভোগে’।
ইফতারে বাহারী আর দামী খাবারের ভিড়ে ‘ত্যাগ’ কোথায় হারিয়ে যায়, নিজেও বুঝতে পারেন না। খেতে খেতে মাগরিবের নামাজের জামাতে অংশ নেওয়া হয়না অনেকের! অথচ মসজিদে জামাতে ফরজ নামাজ আদায় ২৭ গুণ সওয়াব, রমজানে আরও ৭০ গুন বাড়ে। খাবার দেখে বেমালুম এসব ভুলে যাই। আপনি সারাদিন রোজা রেখে জামাতে নামাজ আদায়ে আপনার মন কাঁদে না, এই ত্যাগ দিয়ে আপনি কি করবেন?
পত্রিকায় রমজানে উপকারীতা নিয়ে লেখায় একটা বড় অংশজুড়ে থাকে, এই রোজা আপনাকে অনাহারী মানুষের কষ্ট বোঝাতে সাহায্য করে, আছ আরো কতো কিছু। বাস্তবে কী তাই ?
বরং সারাদিন না খেয়ে অপেক্ষায় থাকি, কখন মাগরিবের আযান দিবে সারাদিনের সব খাবার একসঙ্গে খাব। সারাদিন শেষে পছন্দের সব খাবার ভরপেট খেয়ে আপনি অনাহারী মানুষের কষ্ট বুঝতে পারবেন ?
সারাদিন না খেয়ে ইফতারের সঙ্গে পুরোটা পুষিয়ে নেওয়ার নাম কি ‘ত্যাগ’ ?
এতোক্ষণ ব্যক্তি পর্যায়ের কথা বললাম। সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন সংগঠন যেন আরও একধাপ এগিয়ে। ইফতারটাকে তারা একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে রূপ দিয়েছে। ইফতার যে একটা ইবাদত, এসব অনেকটা ভুলেই গেছে।
ইফতার পার্টি নিয়ে যা হয়, তাকে ইবাদত বলা যায় ? আইটেম নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ওরা এই এই আইটেম দিয়েছে, আমাদের এগুলো দিতে হবে। এটা না খাওয়ালে আমাদের মান সম্মান থাকবে না-কতো রকম কথা। একেক প্লেট ইফতারিতে ৬০০-৭০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এই এক প্লেট ইফতারির টাকায় ছোট একটি পরিবারের অনেক দিনের ইফতারি হয়ে যায়।
ইফতার পার্টিতে যাদের দাওয়াত দেওয়া হয় তারা আবার সব খানও না। দেখা যায়, প্লেটের অনেক খাবার পড়ে থাকে। এই সব ইফতার পার্টিতে যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হয়, তা দিয়ে কয়েকশ’ পরিবারের সারা মাসের বাজার হয়ে যাবে।
সবকিছু আমার নিজের চোখে দেখা। আপনারাও বুঝতে পারছেন, এর একলাইনও ভুল নয়।
অনেকবার বলেছি, বর্তমানে একটা সংকটকাল চলছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে নেমে গেছে। ইফতারের ছোলা-মুড়িও অনেকের পাতে জুটবে কিনা সন্দেহ। এমন সময় ইফতারের নামে এই ভোগ-বিলাস রমজানকে কতোটা পবিত্র করবে ? ইফতার পার্টির নামে এমন আয়োজন গত কয়েক বছর ধরে সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। পাল্লা দিয়ে এই আয়োজনে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থাও যোগ দিয়েছে। অথচ অতীতে কখনও এসব দেখা যায়নি।
প্রতিষ্ঠানগুলোর নিম্নআয়ের শত শত কর্মী তিন বেলা ভালো করে খেতে পারে না, ইফতার সামগ্রী কিনতে পারে না, অথচ এদের দেখা যায় সমাজের উচ্চবর্গীয় লোকদের ইফতার করাতে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে। এই করে ওই প্রতিষ্ঠানের কি লাভ ? এই যে এতো সংগঠন পার্টির নামে এমন ভোগ-বিলাস, খাবার অপচয় করে তাদের কী লাভ ?
একটু আগে দেখলাম, ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে এবারের রমজানে গণভবনে কোনো ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন না প্রধানমন্ত্রী । সংবাদটি দেখে খুবই ভালো লেগেছে।
আচ্ছা, আওয়ামী লীগ, তাদের সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা, সরকারি কর্মকর্তারাতো প্রধানমন্ত্রীকে অনুসরণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি নির্দেশনা, তার চাওয়া, পছন্দকে গুরুত্ব দেন। তাহলে এই বিষয়ে আপনারা শিক্ষা নিচ্ছেন না কেন ?
এই সংকটকালে সবাই যদি তার গরীব আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, রাজনৈতিক দল, সংগঠন প্রতিষ্ঠান অফিসের অধিনস্তদের পাশে দাড়ায়, ইফতারের ‘ভোগ’ বাদ দিয়ে সত্যিকারের ‘ত্যাগ’ এ উৎসাহিত হয়-তাহলে আর কোনো সংকট থাকে ? আমার তো মনে হয় না। প্রয়োজন শুধু সঠিক পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করা। যারা আপনার কাছে চাইবে না, আপনি খুঁজে বের করে তাদের পাশে দাড়াবেন।
আগেও কয়েকবার বলেছি, ইফতারে দামি খাবার পেট ভরে খাওয়ার চেয়ে কয়েকটি পরিবারের খাবারের সংস্থান করে দিন। আপনি যে তৃপ্তি পাবেন-পৃথিবীর সবচেয়ে মজাদার খাবারেও সেই তৃপ্তি পাবেন না।
আমার কথা পরীক্ষা করে দেখুন, গোপনে কয়েকটি পরিবারের পাশে দাড়ান, আমার কথা অসত্য হলে আমি আপনাকে খাওয়াবো।
সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্যে বলছি, এমন ব্যয়বহুল ইফতার পার্টি বাদ দিন, মানুষের পাশে দাড়ান। এলিট শ্রেণির মানুষকে এক বেলা খাইয়ে কতোটা সুনাম হবে জানি না। মানুষের পাশে দাড়ান এরচেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসা, সম্মান পাবেন। সবচেয়ে বড় বিষয় আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পাবেন।
এ সব দেখে ভালো লাগে না। মন খারাপ হয়। কিন্তু আমার সামর্থ্য শুধু আপনাদের বলা বা লেখা পর্যন্ত। তাই লিখলাম। আমি জানি, এই লেখায় কিছুই হবে না। কোনো ইফতার পার্টি বন্ধ হবে না। বাড়ির আয়োজনও হয়তো কমবে না। কিন্তু তারপরও বলতে হবে। আমার সঙ্গে আপনাকেও বলতে হবে। এটা আল্লাহর নির্দেশ, রোজা রাখার মতোই ফরজ ইবাদত।
‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (লোককে) ভালোর দিকে ডাকবে ও সৎ কর্মের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কর্ম থেকে বিরত রাখবে। আর এসব লোকই হবে সফলকাম।’-সূরা আলে ইমরান -১০৪
আল্লাহ আমাদের রোজাগুলোকে কবুল করুন।
রমজান মাসকে আমাদের জীবনে পরিবর্তন, রহমত, বরকত ও নাজাতের উসিলা বানাক।
আমাদের ক্ষমা করুন। আমিন