খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

মুরগির বাজার চড়া, বিপাকে ক্রেতা-বিক্রেতা-খামারিরা

একরামুল হক লিপু

আমার একটি এক হাজার মুরগির শেডের খামার ছিল। আমি প্রায় চার বছর পালন করার পর ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি। খাবারের দাম বাড়তি কিন্তু সেই তুলনায় ডিমের দাম কম। সমিতি থেকে লোন নিয়ে সেই লোন পরিশোধ করতে পারিনি। ধীরে ধীরে আমার খামারটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমি ডিম সংগ্রহ করে বিক্রি করি। এমনভাবেই বলছিলেন খুলনার বটিয়াঘাটা গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের খলিশাবুনিয়া গ্রামের খামারি বিশ্বজিৎ তরফদার।

তিনি বলেন, শুধু আমার খামারই নয়, বন্ধ হয়েছে অসংখ্যা খামারের শেড।

দিঘলিয়া সরদারপাড়া গ্রামের খামারি ইলিয়াস সর্দার বলেন, বিদেশ থেকে এসে দুই বছর হলো পোলট্রির ব্যবসা করছি। আগে এ ব্যবসা ভালেই ছিল কিন্তু এখন খারাপ অবস্থা। এখন মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দাম অনেক বেশি। কিন্তু মুরগি বিক্রি করতে গেলে দাম কম। অর্ধেকের বেশি লোক খামার বন্ধ করে বসে আছেন।

এদিকে এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ১০০ টাকা। বাজার চড়া থাকায় বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। খাবারের দামসহ বাজার নিয়ন্ত্রণ না করলে খামারিরা চরম লোকসানের মুখে পড়বেন। এজন্য পোলট্রি ফিডের দামসহ বাজার নিয়ন্ত্রণের দাবি খামারিদের। এছাড়া পোলট্রি ফিডের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও ন্যায্য দাম না পাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় ইতোমধ্যে অনেক খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য মতে, খুলনায় ২ হাজার ৪৯২টি পোলট্রি খামার রয়েছে। তবে মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জেলার প্রান্তিক পর্যায়ে ৪ হাজার ৯৫২টি পোলট্রি খামার রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ১ হাজার খামার বন্ধ হয়ে গেছে।

নগরীর লবণচরা রিয়া বাজারের পোলট্রি খাবার বিক্রেতা মনির মোল্লা বলেন, পোলট্রির খাবারের দাম বেড়েছে। দুই দফায় এক বস্তা খাবারের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। আগে এক বস্তা খাবারের দাম ছিল ৩ হাজার টাকা, বর্তমানে সেই খাবারের দাম ৩ হাজার ২০০ টাকা। যেমন দামে কিনেছি, তেমনি বিক্রি করছি।

খুলনার বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের মুরগির দাম কেজিতে ৬০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে । আগে যে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা কেজি, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। লেয়ার মুরগি আগে বিক্রি হয়েছে ২৩০ টাকা কেজিতে, এখন ২৯০ টাকা। আর সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেটে আসা মুরগির ক্রেতা মো. ফারুক হোসেন বলেন, মুরগির দাম গরিবের নাগালের বাইরে। কিনতে গেলে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।

খালিশপুর প্লাটিনাম গেট এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, মুরগির দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে ব্রয়লার মুরগির দাম ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি ছিল। তখন কিনতে পারতাম। এখন ২৪০ টাকা হয়েছে, যা আমাদের নাগালের বাইরে। শুক্রবারে গরুর গোশত কেনা দূরের কথা মুরগি কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এদিকে মুরগির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রিও কমেছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেটের মুরগি বিক্রেতা মো. লিটন হোসেন বলেন, বেচাকেনা অনেক খারাপ। আগের চেয়ে অর্ধেকেরও বেশি বিক্রি কমে গেছে। কি আর করার, সবকিছুর দাম বেশি। মানুষ মুরগি কিনবে না অন্য বাজার করবে!

মুরগি বিক্রেতা শের-এ-আলম বলেন, একটি মুরগি ২২৫ টাকায় পাইকারি কিনে ড্রেসিং করে ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করি। এতে আমাদের পাঁচ টাকার মতো লাভ হয়। কিন্তু এখন কাস্টমার তেমন নেই বললেই চলে।

খুলনা পোলট্রি ফিশ ফিড শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এসএম সোহরাব হোসেন বলেন, আগে যেখানে একটি মুরগির বাচ্চা ৮ থেকে ১০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেই বাচ্চার দাম ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। এছাড়া মুরগির খাবারের দাম আগে ছিল প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এখন সেই খাবারের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। মুরগি উৎপাদনে যে টাকা ব্যয় হচ্ছে, সেই টাকা উঠছে না। ফলে অনেকে ধারদেনা করে এখন ব্যবসা গুটিয়ে পথে বসেছে। অনেকে ধারদেনার দায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের নামে মামলা হচ্ছে। খামারিরা খুব দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে প্রাণিসম্পদের কর্মকর্তারা যদি কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে খামারিরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

খুলনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অরুণ কান্তি মন্ডল বলেন, বর্তমানে পোলট্রি খাবারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মুরগির খাবারের জন্য ভুট্টার প্রয়োজন। এই ভুট্টা আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ১৮ টাকার ভুট্টা এখন বেড়ে ৩৮ থেকে ৪২ টাকা হয়েছে। এছাড়া সয়াবিনের খৈলও আমদানি করা হয়। ১০০ কেজির মধ্যে ৭৫ কেজি ভুট্টা ও সয়াবিনের খৈল দিয়ে খাবার তৈরি হয়। এসবের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। প্রতিটি খাবারের মূল্য বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এখন লেয়ার মুরগির এক কেজি খাবারের দাম ৭২ থেকে ৭৫ টাকা। সঙ্গত কারণে খামারিদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে ডিম ও মুরগির মাংসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে যখন খাবার ও বাচ্চার দাম কমতে থাকবে, তখন মুরগি ও ডিমের দামও কমতে থাকবে।

খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, খুলনায় কিছু খামার বন্ধ হয়েছে এটা সত্য। আবার নতুন করে দু-একটা হয়নি তাও নয়। অনেকে বলছেন এই মুহূর্তে বাচ্চার দাম বেশি, এজন্য খামারে বাচ্চা উঠাচ্ছেন না। সময়-সুযোগ বুঝে তারা বাচ্চা উঠাবেন।

খুলনা গেজেট/এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!