খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের করণীয় (পর্বঃ ০২)

হাফেজ মুফতি জুবায়ের হাসান

(১) ঈসালে সাওয়াবের আরও কিছু উপকারী পদ্ধতিঃ

(রোযা)
রোযা এক মহিমান্বিত ইবাদত, তাকওয়া অর্জনের অনন্য উপায় এবং প্রভূত সওয়াব ও পুণ্যময় কাজ। এক হাদীসে আছে, মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়- একটি আমলের সওয়াব দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ বলেছেন, রোযা ছাড়া। কারণ এ একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য সহবাস ও পানাহার থেকে বিরত থাকে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১

রোযার সওয়াব রেসানি করা বৈধ। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেউ রোযা জিম্মায় রেখে মারা গেলে তার অভিভাবক যেন তার পক্ষ থেকে রোযা রাখে।
-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৫২

عن عائشة رضي الله عنها، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم،قال: من مات
وعليه صيام صام عنه وليه
ইবাদাতে মালিয়া যথা সদকা ও গোলাম আযাদ করার সওয়াব পৌঁছার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আলেমদের কোনও মতভেদ নেই। যেমন মতভেদ নেই দুআ, ইস্তিগফার, জানাযার নামায ও কবরের পাশের দুআ পৌঁছার ব্যাপারে। মতভেদ হয়েছে শুধু শারীরিক ইবাদত যেমন রোযা, নামায ও কুরআন তিলাওয়াতের সওয়াব পৌঁছা রক্ষেত্রে। তবে সঠিক হল সবকিছুই তার কাছে পৌঁছে।

(নামায)
নামায অতি মহিমাময় এক ইবাদত, আল্লাহর কাছে সমর্পণের অতুল্য পন্থা এবং অত্যন্ত ফযীলত ও সওয়াবের বিষয়। নামায পড়ে মৃত ব্যক্তিকে সওয়াব পৌঁছানো জায়েয। আমরা আগে দেখেছি যে, অর্থও দেহের সমন্বিত ইবাদত তো বটেই রোযার মত নিখুঁত ইবাদাতে বাদানিয়ারও ঈসালে সওয়াব জায়েয। এ থেকে বোঝা যায় যে, নামাযের ঈসালে সওয়াব করাও জায়েয। ইবনে কুদামা রাহ. (৬২০হি.) দুআ, ইস্তিগফার, হজ্ব ও রোযার ঈসালে সওয়াব সংক্রান্ত কিছু হাদীস উল্লেখ করে বলেন,
وهذه أحاديث صحاح، وفيها دلالة على انتفاع الميت بسائر القرب؛لأن الصوم والحج والدعاء والاستغفار عبادات بدنية، وقد أوصل الله نفعها إلى الميت،فكذلك ما سواها
এগুলো সহীহ হাদীস এবং এ থেকে বোঝা যায় যে, সকল নেক আমল মাইয়িতের উপকারে আসবে। কারণ রোযা, হজ্ব, দুআ ও ইস্তিগফার ইবাদাতে বাদানিয়া হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ এর কল্যাণ মৃত ব্যক্তিকে পৌঁছান। সুতরাং অন্যান্য নেক আমলের হুকুমও একই হবে।
-আলমুগনী ৩/৫২১; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৫৩; তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/৪২০-৪২১

(কুরআন তিলাওয়াত)
কুরআন মাজীদ অমূল্য নিআমত, যা বিশ্ববাসীর হেদায়েতের জন্য নাযিল হয়েছে। এ আদ্যোপান্ত আলো ও হেদায়েত। এতে রয়েছে মানবজাতির পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ পথনির্দেশনা। এর তিলাওয়াতে হৃদয়-ভুবন আলোকিত হয়। অর্থ-মর্মে মনন-মেধা উদ্ভাসিত হয়। অনুসরণে জীবন-জগত জ্যোতির্ময় হয়। এই হেদায়েতে জীবন পরিচালিত করা এবং এই আলোতে জীবন উদ্ভাসিত করার পক্ষে এক বড় সহায়ক হল তিলাওয়াত। তিলাওয়াত একটি স্বতন্ত্র ইবাদতও বটে। তাইবেশি বেশি তিলাওয়াত করা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। হাদীসে এ ব্যাপারে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।আগের আলোচনা থেকেই বোঝা গেছে যে, কুরআন তিলাওয়াতের ঈসালে সওয়াব করা জায়েয। রোযা আর কুরআন তিলাওয়াতের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। দুটোই ইবাদাতে বাদানিয়া এবং নিম্নোক্ত বর্ণনা থেকেও এর বৈধতা বোঝা যায়। মাকিল ইবনে ইয়াসার রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের মাইয়িতের জন্য সূরা ইয়াসীন পাঠ কর। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১২১

عن معقل بن يسار، قال: قال النبي صلى الله عليه وسلم: اقرءوا يسعلى موتاكم
সুতরাং সামগ্রিকভাবে এটা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন তিলাওয়াত মাইয়িতের উপকারে আসে।
ইমাম ইবনে কুদামা রাহ. তিলাওয়াতের সওয়াব রেসানির বৈধতার দলীল আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,
وأنه إجماع المسلمين، فإنهم في كل عصر ومصر يجتمعون ويقرؤونالقرآن، ويهدون ثوابه إلى موتاهم، من غير نكير
এতে মুসলমানদের ইজমা আছে। প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক শহরে তারাসমবেত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে সওয়াব রেসানি করেছে। এতে কেউ কোনও আপত্তি করেনি। -আলমুগনী ৩/৫২২

(দুআ)
ইবাদতের সারনির্যাস হচ্ছে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ সমর্পণ এবং চূড়ান্ত বিনয় ও মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ। আর এটা দুআর মধ্যে সর্বোত্তমরূপে প্রকাশিত হয়। দুআ অর্থ ডাকা। নিজেকে অসহায় ও নিঃস্ব মনে করে কারো সামনে দু’হাত প্রসারিত করার চেয়ে বিনয় ও সমর্পণ আর কী হতে পারে? তাই দুআর মর্যাদা ও গুরুত্ব অসীম। হাদীসে দুআকে ইবাদত বরং ইবাদতের মগজ বলা হয়েছে। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের একটি সাধারণ হক হল, আপন-পরজীবিত-মৃত নির্বিশেষে সকল মুসলিম ভাইয়ের জন্য দুআ করা। আর যারা না-ফেরার জগতে পাড়ি জমিয়েছেন তারা যেহেতু কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন এবং আমাদের আগে ঈমান এনেছেন তাই তাদের জন্য বিশেষভাবে কাম্য। দুআ জীবিত-মৃত সকলের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। কুরআন ও হাদীস দ্বারা তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,
وَالَّذِیْنَ جَآءُوْ مِنْۢ بَعْدِهِمْ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِاِخْوَانِنَا الَّذِیْنَ سَبَقُوْنَا بِالْاِیْمَانِ وَ لَا تَجْعَلْ فِیْ قُلُوْبِنَاغِلًّا لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَاۤ اِنَّكَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ۠
এবং (গনীমতের সম্পদ তাদেরও প্রাপ্য আছে) যারা তাদের (অর্থাৎ মুহাজির ওআনসারদের) পরে এসেছে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! ক্ষমা করুন আমাদের এবং আমাদের সেই ভাইদেরও যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোনো হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু। -সূরা হাশর (৫৯) : ১০

এখানে পূববর্তী মুমিনদের জন্য (যাতে জীবিত ও মৃত সকলই আছেন) দুআ করার প্রশংসা করা হয়েছে। দুআ যদি তাদের জন্য উপকারী না হয়, তবে এ প্রশংসার কী অর্থ থাকে? হাফেয সাখাবী রহ. বলেন, এখানে পূর্ববর্তীদের জন্য দুআ করায় তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। বোঝা গেল যে, দুআ উপকারে আসে।
-কুররাতুল আইন পৃ. ১২৩

দুআ মৃতের পক্ষে কল্যাণকর হওয়ার সবচেয়ে বড় দলীল হল জানাযার নামায। জানাযার নামায বস্তুত সালাতরূপ দুআ। জানাযার নামাযে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব দুআ পড়তেন সেগুলো থেকেই তা পরিষ্কার। এজন্য নিষ্ঠার সাথে দুআ করা কাম্য। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
إذاصليتم على الميت فأخلصوا له الدعاء
তোমরা যখনমাইয়িতের নামায পড়বে তখন তার জন্য নিষ্ঠার সাথে দুআ করবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১৯৯

একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আমের রা.-কে এক যুদ্ধে আমীর নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলেন। একটি তীরের আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তার আগে ভাতিজা আবু মূসা আশআরী রা.-কে বলে গেছেন, তিনি যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার সালাম পৌঁছান এবং তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে বলেন। আবু মূসা আশআরী রা. তা-ই করলেন। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি আনিয়ে অযু করলেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে দুআ করলেন,
اللهماغفر لعبيد أبي عامر، اللهم اجعله يوم القيامة فوق كثير من خلقك أو من الناس
হে আল্লাহ! আপনি আবু আমেরকে মাফ করে দিন। তাকে কিয়ামতের দিন আপনার বহু সৃষ্টির উপর (বর্ণনাকারী বলেন, অথবাবলেছেন, মানুষের উপর) মর্যাদা দিন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৯৮ এই আয়াত ও হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, দুআ জীবিত ও মৃত সকলের জন্য কল্যাণকর।

(যেকোনও নেক আমল)
নেক আমলের জগত অনেক বিস্তৃত। এগুলো কোথাও ‘আলআমালুস সালিহ’র শিরোনামে বর্ণিত হয়েছে, কোথাও ‘আলবির’র শিরোনামে, কোথাও ‘আলহাসানা’র শিরোনামে, কোথাও ‘আলখাইর’র শিরোনামে। কখনো বা বিশেষ শিরোনাম ছাড়া বর্ণিত হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহে যেসব নেক কাজ সুস্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর তালিকাও বেশ লম্বা। বিশিষ্ট ইমাম আবু বকর ইবনে আরাবী রাহ. বলেন,
فإن منفعة فعل الحي عن الميت تصل إليه باتفاق من الأمة، وإنكان في تفصيل ذلك اختلاف، والصحيح عندي أنه يصل إليه كل عمل، وبالله التوفيق
মৃতের নামে করা জীবিত ব্যক্তির আমলের কল্যাণ সর্বসম্মতিক্রমে মাইয়িতের কাছে পৌঁছে। যদিও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কিছুমতভেদ আছে। আমার মতে সহীহ হল সব আমলের সওয়াব তার কাছে পৌঁছে। -আলকাবাস ফী শরহি মুআত্তা মালেক ইবনে আনাস পৃ. ৬৪৭; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৫৩; তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/৪১৯

লেখক: খতিব কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সদস্য আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!