দেশ ও নিজের সম্মান রাখতে প্রতিদিন পঞ্চাশ ডলার হোটেল ভাড়া দিয়ে মাসের পর মাস অবস্থান করা যুক্তিযুক্ত নয়। তাই কয়েকদিনের মধ্যে স্থানীয় দোভাষীদের সহায়তায় একটা বাড়ির এক রুম ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করলাম। আমি একা বাংলাদেশি হওয়ায় রান্না করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আমার কাজের উপর উর্ধতন মহলের আস্থা বাড়ার সাথে সাথে ঘাড়ের ওপর দায়িত্ব আরো বেশি ভর করলো। এক পর্যায়ে দায়িত্বের বোঝা বাড়তে বাড়তে খাওয়া ঘুম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। ওদিকে আমি যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেই বাড়ি ওয়ালার একটি দুই/তিন বছরের ছেলে আমার ভীষণ ভক্ত হয়ে গেল। বাসা থেকে অফিসে বা অন্য কোথাও বের হতে গেলেই সে আমার গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাকে রেখে গেলেই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করতো। এত সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটিকে তাই মাঝে মাঝে গাড়িতে নিয়ে ঘুরতে হতো। আমার দুটো সন্তানকে দেশে রেখে যাওয়ায় বেশ মন খারাপ হতো। ঐ শিশুটির ভালবাসা আমাকে ভীষণ আনন্দ দিতো।
এভাবে চলতে চলতে একাকিত্ব বুঝবার সময় পেতাম না। একদিন আমার মিশরীয় বস আমাকে ডেকে বললেন, Some officer of investigation team are in leave, so you have to join with the team.
আমি ভীষণ খুশি হলাম। সাধারণ মনিটর থেকে তদন্ত টীমে স্থান পাওয়া অত্যন্ত সম্মানের বিষয় ছিল। তদন্ত টীমের অফিসের সময় নির্দিষ্ট ছিল না। যে-কোন সময় ডাক পড়তে পারে এবং ঝুঁকি নিয়ে তদন্ত করতে হবে। তদন্তে সহায়তা করার জন্য সার্বক্ষণিক কয়েকজন দোভাষী অফিসে প্রস্তুত থাকতেন। বাংলাদেশের মতো যেকোন ঘটনার সংবাদ পেলেই দোভাষী নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে সকল ঘটনা তদন্ত করে অফিসে গিয়ে রিপোর্ট তৈরী করে দিলে প্রাদেশিক হেডকোয়ার্টার হয়ে রাজধানী নমপেন চলে যেত।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশিদের দক্ষতা নিয়ে বসদের আস্থা কম ছিল। তাই আমাদের সকলকে সাধারণ পেট্রোল ডিউটি ছাড়া অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাইতেন না। আমি তদন্ত টীমে যোগদান করার পর আমাকে ছোটখাটো ঘটনা তদন্তে পাঠাতেন। পর পর কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করে তাৎক্ষণিকভাবে রিপোর্ট পাঠানোর পর আমার দিকে সকলের নজর পড়লো। তদন্ত টীম দুই ধরনের ছিল। একটা জেলা পর্যায়ে ও একটি বিভাগীয় পর্যায়ে। জেলার টীম ছোটখাটো ঘটনা তদন্ত করে বিভাগীয় অফিসে পাঠানোর পর তারা আরো পর্যালোচনা করে রাজধানী হেডকোয়ার্টারে পাঠাতেন। সেই আমলে জাতিসংঘের মতো অফিসেও কোন কম্পিউটার ছিল না। কিছু সনাতনী টাইপ মেশিন ও কিছু ইলেকট্রিক টাইপ মেশিনে সকল রিপোর্ট লেখা লাগতো। আমি ভাল টাইপ করতে পারতাম না। তাই তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে কষ্ট হতো। একজন ইন্ডিয়ান অফিসার ভাল দ্রুত টাইপ করতে পারতেন। আমি হাতে রিপোর্ট লিখে তাঁর কাছে টাইপ করতে দিলে তিনি এড়িয়ে যেতেন। কিন্তু আমার সাথে থাকা কম্বোডিয়ান দোভাষীরা আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। তারা আমাকে মন দিয়ে সাহায্য করতেন। জাতিসংঘে কর্মরত বিভিন্ন দেশের লোকজন স্থানীয় লোকদের মনে মনে অবমূল্যায়ন করতেন। আমাদের সাথে থাকা স্থানীয় দোভাষীরা সেটা বুঝলেও মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। কিন্তু আমি তাদেরকে মন থেকে ভালবাসতাম এবং মাঝে মাঝে তাদরকে নিয়ে আমার সাথে হোটেলে খাওয়াতাম। আমি বাজারে গিয়ে কেনাকাটার সময় তাদেরকেও কিছু কিনে দিতাম। আমরা প্রতিদিন বেতন পেতাম ১৪৫ ডলার। অর্থাৎ মাসে প্রায় ৫০০০ ডলার। আর তারা সারামাসে বেতন পেতেন মাত্র ১০০ ডলার। জাতিসংঘের এই বৈষম্য দেখে আমার খুব খারাপ লাগতো। তাদেরকে মন থেকে ভালবাসার ফলে এক পর্যায়ে সকল স্থানীয় দোভাষী আমার মারাত্মক ভক্ত হয়ে পড়লেন। আমি কোন তদন্তে বাইরে গেলেই সকল দোভাষী আমার গাড়িতে উঠার জন্য কাড়াকাড়ি করতেন এবং অন্যান্যদের সাথে যেতে অনীহা প্রকাশ করতেন। অবশ্য তাতে জাতিসংঘের অন্যান্য দেশের লোকজন একটু অখুশি ছিলেন। আমি তাদের মনোভাব বুঝতে পেরেও তেমন পাত্তা দিতাম না।
কয়েকটি ছোটখাটো ঘটনা তদন্ত করে দ্রুত রিপোর্ট দাখিল করার পর প্রভিন্সিয়াল কমান্ডার মি.ডাউলিং তাঁর অফিসে আমাকে তলব করলেন। আমি তাঁর অফিসে যাওয়ামাত্র তিনি আমার তদন্তের ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন,
Mr. Islam,
I am highly satisfied with your inquiry report. The Phonomphen Headquarters are also highly pleased. So, I want to keep you attached with our provincial investigation team in addition to your district responsibility. I know that it will be very difficult for you. If you need more support, you can take another investigator from your contingent with you. But he should be like you. Otherwise, he will be back to the district again. He may stay with you in same residence. You are serving here alone. No Bangladeshi is with you. It is very harmful for you. From today you are the Chief of investigation team of the district and member of the Provincial team. please always keep in touch with the radio. You will play one more additional role. That is – you have to maintain close liaison with BANBAT. (Bangladesh Battalion অর্থাৎ ঐ প্রদেশে কর্মরত বাংলাদেশ আর্মি )
কথা শেষ করে ইনভেস্টিগেশন টীমের ওয়ারলেসটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, Your call sigh is CPQ 115. You may call me at any time.
আমি ওয়ারলেস হাতে নিয়ে ও নতুন দায়িত্ব পেয়ে ভীষণ খুশী হলাম। জেলা থেকে কাকে আমার সাথে নেবো তা ভাবতে লাগলাম। আমার তদন্ত টীমে যোগদানের খবর শুনে বাংলাদেশের সকলেই খুব উদগ্রীব ছিলেন। জেলায় বসে আমার কঠিন দায়িত্বের খবর তাঁরা সকলেই জানতেন। আমার সম্মান ও মর্যাদা বাড়ার সাথে সাথে দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা আরো বেশি বেড়ে গিয়েছিল। অনেক সময় জেলা থেকে আমার সাথে জরুরী প্রয়োজনে দেখা করতে এসে কেউ কেউ দেখা করতে পারতেন না; অথবা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। তাই মনে মনে সকলেই প্রাদেশিক শহরে পোস্টিং নিতে চাইলেও সাহস করতেন না। শেষ পর্যন্ত আমার চেয়ে বেশ সিনিয়র ইন্সপেক্টর জনাব সাখাওয়াত হোসেন সাহেব আসতে রাজি হলেন। আমি মি. ডাউলিয়ের মাধ্যমে তাঁকে হেডকোয়ার্টারে আনার ব্যবস্থা করলাম।
জনাব সাখাওয়াত সাহেব হেডকোয়ার্টারে যোগদান করে আমার বাসায় উঠলেন। আমার সাথে ঐ বাড়িতে অন্যান্য রুমে আলজেরীয় পুলিশের লোকজন ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সুতরাং সাখাওয়াত সাহেব আমার রুমে কয়েকদিন ডাবলিং করে অফিস করতে লাগলেন। চার/পাঁচ দিনের মধ্যে আমরা দুজনে থাকার জন্য দুই রুম বিশিষ্ট একটি আলাদা ভাল বাসা ঠিক করে সেখানে উঠে পড়লাম।
একদিন মি. ডাউলিং তাঁকে একটা ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু প্রায় সাত দিন ধরে তদন্ত করে তিনি রিপোর্ট দাখিল করার পর মি. ডাউলিং আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে বললেন, Let him go back to the old district. He is extraordinary learned person. We need an investor like you. We want prompt and easy report, not bombastic.
অবশ্য সাখাওয়াত সাহেব মামলা তদন্ত পাওয়ার পর আমি তাঁকে বার বার দ্রুত রিপোর্ট দাখিল করতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বাংলাদেশের ধাঁচে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল- এত দ্রুত রিপোর্ট দিলে আবার বেশি বেশি কাজ ধরিয়ে দিতে পারে। তিনি একটি ডিকশনারী সাথে নিয়ে দাঁতভাঙা ইংরেজি দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, তিনি অনেক ভাল ইংরেজি জানেন। ওদিকে একটি ঘটনা তদন্ত করতে গিয়েই স্থানীয় দোভাষীরা তাঁর সাথে যেতে অনীহা প্রকাশ করলেন। সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল -তিনি ড্রাইভিং জানতেন না। ঘটনা তদন্তে বিলম্ব হওয়া এটাও একটা কারণ ছিল। অবশেষে তাঁর সকল জারিজুরি ওখানেই সমাপ্ত হলো।
আমার শত অনুরোধ সত্ত্বেও মি. ডাউলিং সাহেব তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে রাজি হলেন না। শেষমেশ সাখাওয়াত সাহেবকে পূর্বতন জেলায় ফেরত দিয়ে আসার দায়িত্ব আমার উপরই বর্তালো। তিনি ভীষণ মনোক্ষুণ্ণ হলেন এবং আমার উপর একটু নাখোশ হলেন। আমিও তাঁকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লাম। আমাদের দশ/বারো দিনের সংসারে ভাঙন দেখা দিল। ওদিকে নতুন বাড়িওয়ালা পুরা এক মাসের ভাড়া দাবী করলেন। সাখাওয়াত সাহেব পুরা মাসের ভাড়া চুকিয়ে দিলেন এবং আমি আমার অংশের ভাড়ার চুক্তি একটু বাড়িয়ে দিয়ে ঐ বাড়িতেই রয়ে গেলাম।
বাড়ি ভাড়া নেওয়ার পর দেখলাম রাতেরবেলা স্থানীয় পুলিশ ঐ বাড়িতে হাউজ গার্ড দেয়। বিস্তারিত খবর নিয়ে জানলাম ঐ বাড়ির মালিক একজন ভদ্র মহিলা, যিনি সিয়ামরিয়েপ (আমরা যে প্রদেশে ছিলাম) প্রদেশের গভর্নর। তাঁর স্বামী পলপট বাহিনীর হাতে অনেক আগে নিহত হয়েছিলেন। তিনি উচ্চ শিক্ষিতা হলেও ভাল ইংরেজি বলতে পারতেন না, কিন্তু অনর্গল ফ্রেন্স বলতে পারতেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে নমপেন মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তেন। তাঁর নাম ক্যামরোন।
এক সন্ধ্যায় বাড়িওয়ালা ভদ্র মহিলা আমাকে তাঁর দোতালায় ডেকে পাঠালেন। ঐদিন তাঁর মেয়ে নমপেন থেকে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি ভাল ইংরেজি বলতে পারতেন। তিনি তাঁর মায়ের পক্ষে আমাকে অনেক কথা বুঝিয়ে বললেন। তার কথার সারমর্ম ছিল- তাঁর মা অত্যন্ত ধার্মিক ও কনজারভেটিভ বিধায় অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে বাড়ি ভাড়া দেননি। কারণ প্রায় সব দেশের মানুষ বাসায় মদ খায়, খারাপ মেয়ে এনে ফুর্তিফার্তা করে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ভাল বলে সেটা করে না। বিধায় আমাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন। তাঁর নাম ক্যামরোন ও আমার নাম কামরুল। আমার নামের সাথে তাঁর নামের মিল আছে তাঁর মা সেটা জানেন। তাই আমাকে তিনি ছেলের মত মনে করলেও ভাল ইংরেজি না জানায় ইচ্ছে থাকলেও কথা বলেন না। মা মেয়ের সাথে আলাপ করে আমার মনটা আরো বড় হয়ে গেল।
আনন্দ
জাতিসংঘ মিশনে পদের চেয়ে কাজের মূল্যায়ন অনেক বেশি তা বুঝতে পারলাম।
গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলে কষ্ট বেশি কিন্তু চারপাশের মানুষ তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। এটাও একটা সম্মানের বিষয়।
বেদনা
জনাব সাখাওয়াত সাহেবকে পেয়ে হারিয়ে আমার মন খারাপ হলো। তিনি আসার পর মাঝে মাঝে বাসায় রান্না করে দেশি খাবার খেতাম, কিন্তু তাঁকে হারিয়ে আমার নিয়মিত হোটেলভোজ আবার শুরু হলো। চলবে…
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)