খুলনার কয়রা উপজেলার মালিখালী আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগীরা পানির অভাবে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বসবাসের জন্য চমৎকার ঘর ও আঙ্গিনা থাকার পরেও সুপেয় পানির অভাবে প্রকল্পের মহৎ উদ্যেশ্য বেস্তে যেতে বসেছে। ইতোমধ্যে এক-তৃতীয়াংশের অধিক ঘরে তালা ঝুলিয়ে উপকারভোগীরা চলে গেছেন অন্যত্র।
সরেজমিন সেখানে যেয়ে জানা যায়, নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে ২/৩ কিলোমিটার দূর থেকে কিনে সংগ্রহ করতে হচ্ছে খাবার পানি। রান্নার পানিও আনতে হচ্ছে আধা কিলোমিটার দূরবর্তী একটি পুকুর থেকে। ওই পুকুরের পানি বিশুদ্ধ করেও খাচ্ছেন বেশ কিছু পরিবার। এছাড়া পানির অভাবে তারা করতে পারছেন না চাষাবাদ। এমনকি গরু-ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগীর খামারের মাধ্যমে আর্ত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও হচ্ছে সমস্যা। এছাড়া সেখানে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ, নেই কর্মসংস্থানের কোন সুব্যবস্থা। উদ্বোধনের পর থেকে উপকারভোগীদের আত্নকর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত করতে নেয়া হয়নি কোন উদ্যোগ, দেয়া হয়নি কোন প্রশিক্ষণ।
সালামা, মুক্তা, সবুরসহ বেশ কয়েকজন উপকারভোগী বলেন, সারাদিন কষ্টের পরে ভালো ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে পেরে আমরা অত্যন্ত খুশি। সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে পানির সমস্যায় আমাদের ভোগান্তীর শেষ নেই। আমাদের আশেপাশে কোন সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। ২/৩ কিলোমিটার দূরের হায়াতখালীর ফিল্টার থেকে পানি কিনে খেতে হয়। এখানে যে টিউবওয়েলগুলো দেয়া হয়েছিল সেগুলোর পানি ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল না। ঘোলা, প্রচুর আয়রণ ও লবনাক্ততায় ভরা পানি উঠতো। দীর্ঘদিন ফেলে রাখায় সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর পানি ওঠে না। আধা কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে রান্নার পানি সংগ্রহ করি। তবে পুকুর থেকে সবসময় পানি আনতে দেয়না। বাঁধার শিকার হই আমরা। এছাড়া পানির অভাবে ঠিকমত গোসলও করতে পারিনা। পাশের ঘেরগুলোতে মাছ চাষ করায় তারা আমাদের পানি তুলতে কিংবা গোসল করতে বাধা দেয়। তারা আরও বলেন, এখানে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। একটি পুকুর খননের ব্যবস্থা করতে পারলে পানির ব্যবস্থার পাশাপাশি মাছ চাষের সুযোগ সৃষ্টি হত। ফাঁকা আঙ্গিনায় গাছ লাগাতে পারতাম। তারা জানান,৩/৪ বছর ধরে বসবাস করছি, তবে আজও বিদ্যুত সংযোগ পাইনি। কেউ কেরোসিন ব্যবহার করে ল্যাম্প জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করছেন। আবার কেউ কিংবা সোলারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছেন।
সালমা নামের এক গৃহবধু বলেন, পানির ব্যবস্থা হলে কিছু শাকসবজি লাগিয়ে নিজেদের চাহিদা মোটানোর পাশাপাশি বিক্রি করতে পারতাম। গরু ছাগল পালন করেও আয় করতে পারতাম। কর্মের অভাবে মাঝেমধ্যে জীবিকার তাগিদে খুলনায় চলে যাই। স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন আর আমি বাসা বাড়িতে কাজ করি। সেখানে বাসাভাড়া দিয়ে থেকে খেয়ে আর কিছুই থাকে না।
তিনি আরও বলেন, yচার সদস্যের পরিবারে দু’বেলা আহার জোটাতে হিমসিম খাচ্ছি। ফিল্টারের পানি কিনে খাওয়ার সক্ষমতা নেই। এজন্য কষ্টকরে দূর থেকে পুকুরের পানি এনে খাচ্ছি। থালাবাটি ধোয়া পানি সংরক্ষণ করে সেটা দিয়ে দু’একটা গাছ লাগিয়েছি।
সত্তোরোর্ধ এক বৃদ্ধ বলেন, ঘরে বাইরে দু’জন। কোন রকম চাইয়ে চিন্দে খাই। আর বাড়িওয়ালা (স্ত্রী) হাজিরা খেটে দেড়শ’ থেকে দুইশ টাকা পায়। পানি কিনে খেতে হয়। যখন কিনতে না পারি তখন পুকুরের দুধ নোনতা পানি খাই।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে সুপেয় পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনে কি ধরণের নির্দেশনা ছিল সেটা জানতে কাজের প্রাক্কলন ও বরাদ্দ বিষয়ে খোঁজ নিতে কয়রা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় এটি সেনাবাহিনীর তত্বাবধায়নে করা হয়েছিল। তাদের অফিসে এটির বিষয়ে কোন ফাইল সংরক্ষিত নেই।
কয়রা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইস্তিয়াক আহমেদ বলেন, মুজিব শতবর্ষের ঘরগুলোর জন্য বরাদ্দ আসলেও গুচ্ছগ্রামগুলোর জন্য আমাদের কোন বরাদ্দ কিংবা নির্দেশনা নেই। এজন্য আমরা কিছু করতে পারছি না। আর ওখানে টিউবওয়েল সাকসেস না। পুকুর খনন কিংবা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর ব্যবস্থা করতে পারলে পানির সমস্যা নিরসন হতে পারে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মমিনুর রহমান বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। পানির সমস্যার কথা জানার পরে আমি জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করেছি। দ্রুতই সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি আশ্বাস্ত করেন।
খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আকমল হোসেন বলেন, সেখানে সরাসরি আমাদের বরাদ্দের সুযোগ নেই। তবে উপজেলা প্রশাসন থেকে লিখিতভাবে আমাদেরকে অবহিত করলে প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
খুলনা গেজেট/ টি আই