ঘটনাটি লিখবো না ভেবেছিলাম। কিছু কিছু ঘটনা জনসমক্ষে এড়িয়ে যাওয়া শ্রেয়। কিন্তু কয়েকদিন আগে আমার একজন পাঠক বললেন- ‘ফেসবুকে ও খুলনা গেজেটে আপনার প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রতিটি পর্ব আমি মন দিয়ে পড়ি। আপনার চাকরিজীবনের অনেক কাহিনী আপনি লিখেছেন; কিন্তু আপনি কি জানেন, একদিন আপনি কিভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। আপনি যদি ‘কামরুল ওসি’ না হয়ে, অন্য কেউ ওসি হয়ে ওখানে থাকতেন, তবে ঐদিন তার মৃত্যু অনিবার্য ছিল’।
লোকটির কথা শুনে আমার সব ঘটনা মনে পড়ে গেল। স্পর্শকাতর হওয়ায় সেই ঘটনা আমি লিখবো না ভেবেও আজ লিখতে বসলাম। অবশ্য সেই লোকটি ঐদিনের অজানা ঘটনা আমাকে খুলে না বললে, প্রকৃত ঘটনা আজও আমার অজানা রয়ে যেতো। প্রকৃত ঘটনা জানার পর আমার শরীর বার বার শিউরে উঠলো। যিনি আমাকে প্রকৃত ঘটনাটি জানালেন তার নাম পরিচয় সংগত কারণেই গোপন রাখলাম।
১৯৯১ সালে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে চাকরি করাকালীন আমি খালিশপুর থানার ওসি ছিলাম। এর কয়েকদিন আগে ক্ষমতাসীন বিএনপির কিছু নেতা একজন নিরীহ লোককে মিথ্যা অস্ত্র মামলায় ফাঁসাতে গিয়ে আমার দৃঢ়তার কারণে ব্যর্থ হয়ে একটু নাখোশ হয়েছিলেন। তার কিছুদিন পরে আর একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো।
খালিশপুর রেল লাইনের পাশে একটি লোককে বিএনপির কিছু লোকে আটক করে ডিবি পুলিশের কাছে জানায় যে, ঐ লোকের কাছে ব্যাগের মধ্যে ককটেল আছে। লোকটি ছাত্র শিবিরের নেতা। ডিবি পুলিশ সেখানে গিয়ে লোকটিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের সহায়তায় আটকপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় ছাত্র শিবিরের লোকজন টের পেয়ে পুলিশ ও বিএনপির লোকজনের কাছ থেকে তাদের কর্মীকে ছিনিয়ে নেয়। ডিবি পুলিশ কোনোমতে সেখান থেকে সরে যায় এবং বিএনপির লোকজন বাধ্য হয়ে পিছু হটে যায়। তারপর পিপলস জুট মিলের মাঠে বিএনপির একটি অফিসে নেতাকর্মীরা একজোট হয়ে ছাত্র শিবিরের উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। ওদিকে ছাত্র শিবিরের নেতা কর্মীরা জড়ো হয় তাদের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের অফিসে। উভয় দলের সাথে প্রচুর পরিমাণ লাঠিসোঁটা, রামদা, ককটেল ও কিছু দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তৎকালীন খালিশপুর এলাকায় হাজার হাজার শ্রমিক এক ডাকে মিছিল মিটিং ও মারামারিতে অংশ নিতো। সকল দলের নেতারা এই সহজ সুযোগ হাতছাড়া করতেন না।
যাহোক, পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল মারামারি শুরু হয়ে গেল। পুলিশ লাইন থেকে দাঙ্গা পুলিশ নিয়ে আমি পিপলস গোল চত্বরে গিয়ে উভয় দলকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলাম। পিপলস গোল চত্বরের পশ্চিমে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের হাজার হাজার উত্তেজিত শ্রমিক ও পূর্ব পাশে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে উত্তেজিত শ্রমিক জড় হলো। আমি দাঙ্গা পুলিশ নিয়ে গোল চত্তরে উভয় পক্ষের ইটপাটকেল খেয়ে কোনোমতে সামাল দিতে চেষ্টা করছিলাম।
কিছু সময় পর আমি লক্ষ্য করলাম, পশ্চিম দিকে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দলে লোকজন এত বেশি যে, তারা যদি একবার আমাদের বেরিকেড ভেদ করে পূর্ব দিকে যেতে পারে তাহলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। সুতরাং তাদেরকে পিছু হটানোই সমীচীন মনে করে, তাদের দিকে প্রথমে টিয়ার গ্যাস ছুড়তে শুরু করলাম। এতে করে তারা পুলিশের উপর ক্ষিপ্ত হতে লাগলো। অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীরা সুযোগ বুঝে পুলিশের বেরিকেড অতিক্রম করে লাফাতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন মনে করলো, পুলিশ বিএনপির পক্ষ নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করছে। তাই তারা পুলিশের উপর আরো ক্ষিপ্ত হলো। আমি এক প্রকার নিরুপায় হয়ে পড়লাম। তখন দেখতে পেলাম শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের তৎকালীন নেতা জনাব মিয়া গোলাম পরোয়ার হাতে বাঁশি নিয়ে তাঁর দলকে সামরিক কায়দায় কমান্ড দিচ্ছেন। তাঁকে দেখে আমি সরাসরি বললাম –
‘আপনি যদি আপনার দলকে এখানে থামিয়ে রাখতে পারেন তাহলে আমি ওদেরকে পিটিয়ে সরিয়ে দেবো’।
কিন্তু তাঁর দলের উত্তেজিত জনতা বার বার আমার উপর তেড়ে আসতে লাগলো। কিছুতেই তাদের থামানো যাচ্ছিল না। বরং বিএনপির লোকজন পুলিশের সহায়তায় তাদের উপর আক্রমণ করার সাহস পাচ্ছে বলে পুলিশকে দোষারোপ করতে লাগলো। ইতোমধ্যে উভয় দলের ইটের আঘাতে আমার অনেক পুলিশ আহত হলো। দুই দলের বেশকিছু লোকজন জখম হয়ে গেল। পরিস্থিতি এক প্রকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। আমি হাল ছেড়ে দিলেই, উভয় দলের লোকজন নিহত হওয়ার উপক্রম হলো।
এক পর্যায়ে আমার অনুরোধে জনাব মিয়া গোলাম পরোয়ার তাঁর হাতে থাকা বাঁশিতে ভিন্ন রকম আওয়াজ দিলেন এবং রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন-
‘আমাকে অতিক্রম করে একজন লোকও যাবে না’।
তখন তাঁর দলের সকল লোকজন অবিশ্বাস্যভাবে নরম হয়ে গেল। হাজার হাজার উত্তেজিত জনতা সেখানেই থমকে দাঁড়াল। আমি আমার বাহিনী নিয়ে পূর্বদিকে বিএনপির লোকজন সরাতে কয়েকটি টিয়ার গ্যাস ছুড়ে সেদিকে এগুতে লাগলাম।
তুলনামূলক দুর্বল হওয়ায় তারা সকলেই দৌঁড়ে পালালো। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে উর্ধতন অফিসারবৃন্দ আমাকে ওয়ারলেসে ধন্যবাদ দিলেন। কিন্তু বিএনপির দিকে কয়েকটি টিয়ারগ্যাস ছোড়ার কারণে আমার বিরুদ্ধে নালিশ শুরু হলো। আমি আবার উজানের বাঁকে পড়লাম।
এখানে আমার ‘দৈবক্রমে’ বেঁচে যাওয়ার মতো কী ঘটেছিল সেই রহস্যটি ফাঁস না করলে পাঠকের মনে প্রশ্ন থেকে যেতে পারে।
পুলিশের চাকরিতে এমন মারামারির ঘটনা মোকাবেলা করা তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব ঘটনায় দুই একজন পুলিশ না মরা পর্যন্ত আমাদের দেশে লোকজন বলাবলি করে-
‘পুলিশ অহেতুক বাড়াবাড়ি করেছে’।
ঐদিনের ঘটনায় আমি ‘দৈবক্রমে’ বেঁচে গিয়েছিলাম, তা আমি নিজেও জানতাম না। আগেই বলেছি- কয়েকদিন আগে ঐ মারামারিতে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র শিবিরের একজন তৎকালীন নেতা ফেসবুকে ও খুলনা গেজেটে আমার লেখা পড়ে ঘটনাটা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। কী ছিল সেই ‘দৈবক্রমে’ বেঁচে যাওয়ার ঘটনা?
আমি খুলনা সরকারি বিএল কলেজে পড়াকালীন তৎকালীন ছাত্রনেতা ছাত্র ইউনিয়নের জনাব ফিরোজ আহমেদ, ছাত্রলীগের জনাব মুজিবর রহমান, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর জনাব জহির উদ্দিন স্বপন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জনাব আসাদুজ্জামান রিপন, জনাব আলীরেজা বাবু, ছাত্র শিবিরের জনাব বেলাল উদ্দিন সকলেই আমাকে মোটামুটি চিনতেন।
বিশেষ করে বেলাল উদ্দিন ছিলেন সরাসরি আমার ক্লাসমেট এবং আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিএল কলেজের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহে আমি সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতায় একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। তারপর থেকে সকলেই আমাকে একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখতেন। অনুষ্ঠানের দিন আমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্টেজ থেকে নামার সাথে সাথে বেলাল আমাকে উঁচু করে ধরে নাচতে শুরু করেছিলেন। কারণ তৎকালীন বিএল কলেজের শ্রেষ্ঠ সাধারণ জ্ঞাণী বলে খ্যাত এবং বহুল পরিচিত নেতা জনাব আসাদুজ্জামান রিপনকে আমি ব্যাপক ব্যবধানে হারিয়েছিলাম। বেলাল ও রিপনের সাথে মারাত্মক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল। তাই আমার বিজয়ে বেলাল এত খুশি হয়েছিলেন।
আমার ‘দৈবক্রমে’ বেঁচে যাওয়ার ঘটনাটি আরো পরিস্কার করে বুঝানোর জন্য পুরোপুরি খোলসা করি।
যিনি আমাকে কয়েকদিন আগে এই ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিলেন, তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন-‘ছাত্র শিবিরের লোকজন বিএনপির নির্দেশে খুলনা শহরে পুলিশের দ্বারা বার বার নাজেহাল হওয়ার কারণে গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পুলিশ যদি এভাবে বার বার তাদের নাজহাল করে, তাহলে সুযোগ পেলে পুলিশকে তারা সমুচিত শিক্ষা দেবে। তাতে যদি পুলিশের জীবন হানি হয়, তাও করবে। ঐ গোপন মিটিংয়ে জনাব বেলাল সাহেব হাজির ছিলেন। তখন বেলাল সাহেব বলেছিলেন- ‘সবাই মনে রাখবেন, খালিশপুর থানার ওসি কামরুল আমার বন্ধু। সে একটু বেশি সাহসী এবং মোটামুটি সৎ । তার দিকে সবাই খেয়াল রাখবেন’।
আমার কাছে যিনি ঐ দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন তার ভাষ্যমতে, তিনি ছিলেন খালিশপুরের সেই মারামারিতে ছাত্র শিবিরের নেতৃত্বে। পুলিশের সেদিনের আচরণে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ হাতে পেয়েও, তিনি হাতছাড়া করেছিলেন। কারণ, তিনি ছিলেন ছাত্র শিবিরের পক্ষের নেতা, আর আমি ছিলাম পুলিশের পক্ষের নেতা। তাই সেদিন আমি বা আমার পুলিশের কোন সদস্য নিহত হয়নি।
আনন্দ
ঘটনার দীর্ঘদিন পর এই তথ্য জেনে আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।
ঐ ব্যক্তি ফেসবুকে ও খুলনা গেজেটে আমার লেখা পড়ে আমাকে না বললে চিরকাল আমার কাছে এতবড় ঘটনাটি অজানাই রয়ে যেতো।
তাই, খুলনা গেজেট ও ফেসবুকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
বেদনা
আমার বন্ধু বেলাল পরবর্তীতে খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে আততায়ীর বোমার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন আমি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। পেট্রোল বোমার আঘাতে তাঁর ঝলসানো দেহ দেখে আমি বার বার কেঁদেছিলাম।
কয়েকদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে তিনি চিরবিদায় নিলেন। ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে তাঁর নামাজে জানাজায় শরিক হয়ে আর একবার কেঁদেছিলাম।
বেলালের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে একটি ক্রোড়পত্র বের হয়েছিল। তখন আমার চাকরিগত কারণে সবার নিষেধ অমান্য করে আমি একটা প্রবন্ধ লিখে সেই ক্রোড়পত্রে দিয়েছিলাম।
আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসীব করুন। চলবে…
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)