আল্লাহর অশেষ রহমতে ও সবার বদান্যতায় আমার পদোন্নতি হলো। পোস্টিং পেলাম খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে। আমি বিস্মিত হলাম। আমার আগেই আমার পোস্টিং এর খবর পেয়েছিলেন জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব। তিনি সর্বদাই আমাকে নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। তিনি আমাকে আগেই বলেছিলেন, ‘প্রোমোশনের পোস্টিং নিয়ে তদবির করতে নেই। আল্লাহর ইশারায় কর্তৃপক্ষ যেখানে দেয় সেখানেই যাওয়া উচিৎ’।
তবুও এই অনাকাঙ্ক্ষিত পোস্টিং এর খবর পেয়ে আমি সরাসরি পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে অতিরিক্ত আইজিপি জনাব নসরুল্লাহ খান সাহেবের সাথে দেখা করে বললাম, ‘স্যার, আপনি আমাকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে পোস্টিং দিয়েছেন। কিন্তু, আপনি কি দেখেছেন আমার বাড়ি খুলনায় এবং আমি লেখাপড়া করেছি খুলনায়। ওখানে চাকরি করা আমার জন্য কঠিন হবে।’
আমার কথা শুনে তিনি বললেন,‘আমি কি ভুল করলাম নাকি। আচ্ছা, তুমি ওখানে জয়েন করে দেখো। যদি সমস্যা হয় তাহলে আমি তোমাকে অন্য জায়গায় দেবো।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন থেকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগদান করে আমি কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কমিশনার জনাব শাহুদুল হক সাহেব অত্যন্ত সৎ ও মৃদুভাষী মানুষ ছিলেন। তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে আমাকে থানার ওসি হিসেবে পোস্টিং দিতে না পেরে পেট্রোল ইন্সপেক্টর হিসেবে রাখলেন।
ইতিমধ্যে নতুন পুলিশ কমিশনার হিসেবে জনাব ওসমান আলী খান সাহেব যোগদান করলেন। তিনি সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত সদালাপী ও দিলখোলা মানুষ হিসেবে সমগ্র পুলিশ বিভাগে তাঁর পরিচিতি ছিল। তাঁর যোগদানের কিছুদিন পর খালিশপুর থানা খালি হওয়ায় আমাকে এসি জনাব মোখলেছুর রহমান সাহেব ও ডিসি জনাব মালিক খসরু সাহেব ডেকে নিয়ে পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে হাজির করলেন। আমার মোটামুটি মৌখিক ইন্টারভিউ নিয়ে ঐ দিনই খালিশপুর থানার ওসি হিসেবে পোস্টিং দিলেন।
খালিশপুর থানায় যোগদান করে দেখলাম এলাকা ভীষণ সরগরম। তখনকার দিনে খালিশপুর শিল্প এলাকা মিল কলকারখানার শ্রমিকের পদচারণায় মুখরিত থাকতো। দেশের অধিকাংশ জেলার মানুষের পদভারে খালিশপুর ছিল খুলনার প্রাণ।
বয়সে ও চাকরিতে আমি ছিলাম নবীন। সকল অফিসার আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। কিন্তু খুলনার রাজনীতি ও খালিশপুরের শ্রমিক রাজনীতি ছিল অত্যন্ত জটিল। ঐ এলাকার তৎকালীন সংসদ সদস্য ছিলেন জনাব আশরাফ হোসেন। তিনি তৎকালীন জাতীয় সংসদের মাননীয় হুইপ হিসেবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। তার বাড়ি ছিল নোয়াখালী জেলায়। শ্রমিক রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি খুলনা এলাকার নেতা হয়েছিলেন। সুতরাং খুলনার স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর মতবিরোধ লেগেই থাকতো। দলীয় নেতৃবৃন্দের রেষারেষির জেরে থানার ওসিকে মারাত্মক নাজেহাল হতে হতো। আমার পূর্ববর্তী ওসি জনাব নাজমুল হোসেন সেই রেষারেষির মধ্যে পড়ে ভীষণ নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন। আমার যোগদানের পর আমিও সেই একই অবস্থার শিকার হতে লাগলাম।
একদিন আমি অফিসে বসে কাজ করছিলাম। এমন সময় অফিসের ফোনটি বেজে উঠলো। সাধারণত ডিউটি অফিসার ফোন রিসিভ করতেন। কিন্তু ঐদিন কোন কারণে আমি নিজে ফোন রিসিভ করলাম। ওপার থেকে কোন একজন তার পরিচয় না দিয়ে বললেন,‘খালিশপুর হাউজিংয়ের এত নম্বর বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র আছে। আপনি এখনই গেলে পেয়ে যাবেন।’
আমি ফোন রেখে অফিসার ও ফোর্স নিয়ে সাথে সাথে সেখানে গিয়ে বাড়ি তল্লাশি করে একটি পাইপগান ও কয়েকটি কার্তুজ পেয়ে ওয়ারলেসের মাধ্যমে পুলিশ কমিশনার মহোদয়কে অবহিত করলাম। তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে থানায় ফিরে ফোনে কথা বলার নির্দেশ দিলেন।
বাড়ি তল্লাশি করার সময় ঐ বাড়িতে কোন পুরুষ মানুষ না থাকায় এবং অস্ত্র ও কার্তুজের প্রকৃত রহস্য নিয়ে আমার সন্দেহ হওয়ায় আমি কাউকে আটক না করে শুধুমাত্র অস্ত্র সিজ করে থানায় ফিরে গেলাম।
থানায় গিয়ে আমার সন্দেহের কথা পুলিশ কমিশনার মহোদয় ও সকল অফিসারকে অবহিত করলাম। পুলিশ কমিশনার মহোদয় বললেন,‘তুমি ঘটনাস্থলে থাকতেই কয়েকজন নেতা আমাকে ফোন করে তোমার তাৎক্ষণিক অভিযানের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তবে বাড়ির মালিককে যেভাবে পারো আটক করে তারপর মামলা রেকর্ড কর।’
অন্যান্য অফিসাররা একই পরামর্শ দিলেন। আমি মারাত্মক বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। ইতিমধ্যে অনেক নেতাও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন।
কিন্তু আমার মনের সন্দেহ গেল না। আমি আবার সেই ঘটনাস্থলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম বাড়িতে তালা ঝুলছে। আশেপাশের লোকজনের কাছে ঐ বাড়ির মালিকের পরিচয় জানতে চেষ্টা করলাম। এলাকার অধিকাংশ মানুষ জানালেন, ‘ঐ বাড়ির মালিক অত্যন্ত সৎ লোক। তিনি খুলনার স্থানীয় মানুষ। তিনি কিছুদিন আগে বাড়িটি কিনেছেন, কিন্তু তার বাড়ির চারদিকে বিভিন্ন জেলার লোকজন বসবাস করায় তাদের সাথে বনিবনা হয় না। তাই আশেপাশের লোকজন চায় ঐ লোক ওখানে বসবাস না করুক। বরং তাকে নামমাত্র দাম দিয়ে বাড়িটি কিনে নিতে চায় ‘
ঘটনা বুঝতে আমার বাকী রইলো না। আশেপাশের কিছু মানুষের আনাগোনা দেখে আমার সন্দেহ আরো প্রকট হলো। আমি থানায় ফিরে গিয়ে পুলিশ কমিশনারসহ সকল অফিসারকে প্রকৃত ঘটনা জানালাম। সবাই আমার কথায় আশ্বস্ত হলেন, কিন্তু বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা নিয়ে তদন্ত করে তারপর যা করার করতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আমি সকল অফিসারকে বার বার বুঝাতে চেষ্টা করতে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত সবাই অতিষ্ঠ হয়ে বললেন, ‘তুমি যা মন চায় তাই কর। তবে দায় দায়িত্ব তোমার।’
আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন পুরাতন অফিসারের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত মামলা রেকর্ড না করে বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখপূর্বক একটা লম্বা জিডি করে রাখলাম।
এই ঘটনায় অনেক নেতা আমার উপর মনোক্ষুণ্ণ হলেও সরাসরি কিছু বলতে সাহস করলেন না। কারণ আমি সবার সামনে ঘোষণা দিলাম, ” যে লোকটি ফোন করে আমাকে ঐ অস্ত্রের সন্ধান দিয়েছিল, তাকে পেলে তার বিরুদ্ধে আমি নিয়মিত অস্ত্র মামলা নিয়ে তাকেই জেল খাটাবো”।
বেশ কয়েকদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আমি ঐ ঘটনা এক প্রকার ভুলে গিয়েছিলাম। এমন সময় একদিন আমি অফিসে বসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ একজন আধা বয়সী দাড়িওয়ালা লোক আমার রুমে ঢুকে টেবিলের নিচ দিয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরলো। আমি রীতিমতো হতচকিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে- যতই পা ছাড়ানোর চেষ্টা করি, লোকটা তত জোরে পা আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত সেন্ট্রি ও অন্যান্য অফিসার এসে লোকটাকে টেবিলের নিচ থেকে বের করে জোরপূর্বক আমার সামনের চেয়ারে বসালেন।
কিছুক্ষণ পর একটু শান্ত হয়ে লোকটা একদমে বললেন, “স্যার, কয়েকদিন আগে আমার বাড়ি থেকে আপনি অস্ত্র উদ্ধার করেছিলেন। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমাকে একজন বলেছে আপনি খুব ভাল মানুষ। তাই সাহস করে আপনার কাছে এসেছি। আপনি অনুমতি দিলে আমি বাড়িতে ফিরবো”।
এতক্ষণ পর আমি আসল ঘটনা বুঝতে পারলাম। তাই ঐ অস্ত্র কে বা কারা রেখেছিল তা জানার জন্য বললাম, ‘আচ্ছা আপনি কি জানেন, আপনার বাড়িতে ঐ অস্ত্র কে রেখেছিল।
-না স্যার। আমি কাউকে সন্দেহ করি না। যে রেখেছিল আল্লাহ তার বিচার করবে।
-তবুও একটু অনুমান করে বলতে পারেন।
-না স্যার। এতে আল্লাহ বেজার হবে।
অনেক সময় চেষ্টা করেও ঐ ভদ্রলোকের কাছ থেকে তার সন্দেহের কোন লোকের নাম জানতে না পেরে আমি সকলকে আমার রুম থেকে বের করে দিয়ে, পুনরায় একাকি তার কাছে সন্দেহভাজনের নাম জানতে চাইলাম। কিন্তু তিনি সেই একই কথা বার বার বলতে থাকলেন।
আমি বুঝলাম- তিনি হয়তো অনুমান করতে পারেন, কে তার এই মহাসর্বনাশ করতে চেয়েছিল; কিন্তু তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ হওয়ায় সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কাউকে দোষারোপ করতে চাননি। তাই অহেতুক সময় নষ্ট না করে, তাকে চা খাইয়ে বিদায় দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি বেশ কিছু সময় বসে থেকে কাচুমাচু করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তিনি চেয়ার ছেড়ে আমার পাশে গিয়ে পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমার সামনে দিয়ে বললেন, ‘স্যার আমাকে যিনি আপনার কাছে আসার পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি এটা পাঠিয়েছেন। দয়া করে কিছু মনে করবেন না। এটা নিলে আমি খুশি হবো’।
আমি বললাম, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। ওটা আপনার কাছে রাখেন। আপনি বাড়িতে ফিরে আসলে আমি একদিন বেড়াতে যাবো।’
লোকটি এক প্রকার অসাড় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, ‘স্যার, ঐ বাড়ি কেনার সব টাকা এখনও আমি পরিশোধ করতে পারিনি। এই টাকাগুলো বাড়িওয়ালাকে দিবো বলে রেখেছিলাম। আপনি আমার সম্মান রক্ষা করায় সমুদয় টাকা আপনাকে দিতে এসেছিলাম’।
আমি বললাম, ‘এখন ঐ টাকাগুলো আগের কাজেই লাগান।
তিনি আরো একবার চোখের পানি ফেলে ধীরে ধীরে আমার রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর কখনও ঐ সহজ সরল লোকটির সাথে আমার দেখা হয়নি।
এই ঘটনায় কোন্ নেতা কতটা অখুশি বা খুশি হয়েছিলেন তা ঐ মুহূর্তে আমি উপলব্ধি করতে পারিনি। কিন্তু ঘটনার জের অনেক দূর গড়িয়েছিল, তা কিছুদিনের মধ্যে আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।
আনন্দ
একজন নিরীহ মানুষকে মিথ্যা ও সাজানো মামলার শিকার থেকে স্ব-উদ্যোগে রক্ষা করতে পেরে আমি মানসিকভাবে তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
বেদনা
সরল মনে ভাল কাজ করলে পুলিশের চাকরিতে অনেক সময় বিরূপ ফল ভোগ করা লাগে। কিছুদিনের মধ্যে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। চলবে…
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)