‘আর কত কবো, কতি গেলি সতি পারিনা। সবাই আসে, শোনে চলে যায়। পুরনো স্মৃতি মনে উঠলি বুকটার মধ্যি তুষির আগুন জ্বলে। কেউ সে জ্বালা বোঝে না। তাই আর কতি চাই না। বাতাসে একমাস ধরে ছিল সেই লাশের গন্ধ।’ সোমবার (২১ নভেম্বর, ২০২২) বেলা ১২ টার দিকে কান্নাজড়িতকণ্ঠে এনটাই বলছিলেন একাত্তরে পাকহানাদার বাহিনী ও তাঁদের দোসরদের বর্বরতার শিকার মানদা রায় (৮১)।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার খলিশাখালী গ্রামের মানদা রায় এখনও সরকারি ভাবে বীরঙ্গনা বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। একাত্তরের ২১ জুন দুপুরে পাকহানাদার বাহিনী ও তাঁদের দোসরদের গুলিতে স্বামী নির্মল চন্দ্র রায়কে হারিয়ে তিনি এখন বাস করেন চরখলিশাখালী গ্রামে ছোট মেয়ে লিপিকা বোসের বাড়িতে।
সোমবার মেয়ে লিপিকার বাড়িতে বসে বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া মানদা রায় আরও জানান, ১৯৭১ সালের ২১ জুন দুপুরের দিকে চিতলমারীর দশমহলে রাজাকার ও পাকিস্থানী বাহিনী মিলে আক্রমন করে। সেদিন পাকবাহিনী ভয়ঙ্কর গণগত্যা চালায়। গণহত্যার এদিনে বহু বাড়ির সাথে মানদার বাড়িটিও আক্রান্ত হয়। তিনি স্বামী ও শিশু দুই মেয়েকে নিয়ে পাশের পাট ক্ষেতে আত্মগোপন করেন। এরপর রাজাকাররা ধাওয়া করে তাঁর কোল থেকে শিশু লিপিকাকে ছুড়ে ফেলে এবং মানদার উপর শাররীক নির্যাতন চালায়। এ সময় তাঁর স্বামী নির্মল চন্দ্র রায় তাঁকে রক্ষা করতে আসলে রাজাকাররা স্বামীকে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। অন্যদিকে, আরেক দল রাজাকার তাঁর উপর শাররীক নির্যাতন অব্যাহত রাখে। সেদিন ওরা অগনিত লোককে হত্যা করেছিল। লাশ গুলো ডোবায় পড়েছিল। তিনি স্বামীর সৎকারও করতে পারেনি। বাতাসে একমাস ধরে ছিল সেই লাশের গন্ধ। সংসারে একমাত্র উপর্জানক্ষম ব্যাক্তি ছিলেন তাঁর স্বামী। তাই স্বাধীনতার পর দুই মেয়েকে বড় করতে দিনমজুরের কাজ করেছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
গত ২০২১ সালের ১৯ মে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে বীরাঙ্গনা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু উপস্থিত থেকে তাঁকে সংবর্ধনা ও একটি প্রত্যয়নপত্র দেন।
মানদা রায় সরকারি ভাবে বীরাঙ্গনা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য চলতি বছরের ২২ ফেব্রæয়ারী বাগেরহাট জেলা প্রশাসক বরাবর ও ২৪ ফেব্রæয়ারী চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবরে লিখিত আবেদন করেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন।
চিতলমারীর বীর মুক্তিযোদ্ধা বিপুল কান্তি মন্ডল, প্রমথ নাথ রায়, মৃম্ময় মন্ডল, শান্তি রঞ্জন মন্ডল, নির্মল চন্দ্র বিশ্বাস, মুকন্দ হীরা, হরবিলাস পোদ্দার ও যোগেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘মানদা রায় একজন প্রকৃত বীরাঙ্গনা বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার চাই আর কিছু না হোক, সে মৃত্যুর আগে সরকারি ভাবে স্বীকৃতি পাক।’
চিতলমারী উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা সোহেল পারভেজ বলেন, ‘গত ৬ এপ্রিল ইউএনও অফিস থেকে মানদা রায়ের ব্যাপারে তদন্তের চিঠি পাই। সোমবার (২১ নভেম্বর, ২০২২) দুপুরে তদন্ত করা হয়েছে। খুব দ্রæত উপর মহলে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হবে।’
চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইয়েদা ফয়জুন্নেসা জানান, মানদা রায়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত চলছে। তদন্তে সত্যতা মিললে তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।