খুলনার কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া খালে হঠাৎ যেন টাকার খনি পাওয়া গেছে। এলাকার শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষ, শিক্ষার্থী এমনকি ষাটার্ধো বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও যেন কি একটা খুঁজছে। কেউ পানিতে ডুব দিয়ে তুলছে, আবার কেউ তীরে হাত দিয়ে কিছু খুঁজছে। মাঝে মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে রাস্তার ওপর ওঠে রোদে গাঁ শুকিয়ে ফের নামছে পানিতে। মনে হচ্ছে দু’কিলোমিটার জুড়ে খালে কয়েকশ’ ডুবুরী নেমেছে।
সোমবার সকালে খালের পাশ দিয়ে হেটে যেতে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। পাশে যেয়ে জিজ্ঞাসা করতেই তারা জানান, ঝিনুক খুঁজছেন তারা। খালে প্রচুর ঝিনুক পাওয়া যাচ্ছে। সেটা কুঁড়িয়ে ভালো আয় হচ্ছে তাদের। এদিকে খালের কাঁচের টুকরা কিংবা ঝিনুকের খোলসে হাত কেটে আহতও হচ্ছেন অনেকে।
এদিকে, উপজেলা মৎস্য দপ্তর সূত্রে জানা যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় শামুক-ঝিনুক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এরা যেসব জলাশয়ে থাকে সেখান থেকে ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পানি দুষণমুক্ত রাখতে সহায়তা করে। এজন্য এদেরকে প্রকৃতির ফিল্টার বলা হয়।
হোসেন গাজী নামের ষাটার্ধো এক বৃদ্ধ বলেন, কয়েকদিন ধরে ঝিনুক কুঁড়িয়ে বেশ আয় হচ্ছে। প্রতিদিন ৭০/৮০ কেজি ঝিনুক পাচ্ছি। শীতে লাগছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই বলেন, গরীবের আবার শীত! সৎভাবে কিছু আয় হচ্ছে এটাই বড় কথা।
বসে নেই এলাকার নারীরাও। তারাও দারিদ্রতার সংসারে আয়ের খবরে খুশি মনে খাল থেকে ঝিনুক তুলছেন। তবে তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেন।
দেয়াড়া গ্রামের শাহিনুর রহমান। স্ব-পরিবারে ঝিনুক কুঁড়াচ্ছেন। আবার এলাকার লোকদের কাছ থেকে কিনে ২০ কিলোমিটার দূরের পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী বাজারে বিক্রিও করছেন তার ছেলে আজমল। আজমল বলেন, আমাদের কুঁড়ানো ৩/৪ মণের সাথে এলাকা থেকে ১০/১২ মণ কিনে নিজ ভ্যানে চাঁদখালী বাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছি। ভালো আয় হচ্ছে।
তামিম নামের এক কিশোর জানান, ৪ দিন আগে জানতে পারি। প্রতিদিন দেড়/ দুই মণ ঝিনুক পাচ্ছেন। প্রথম দিন ৪ টাকা কেজি বিক্রি করেন। তবে আজ বিক্রি হয়েছে ৬ টাকা কেজি।
স্থানীয় একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসার ৭/৮ জন শিক্ষার্থী এক সাথে কুঁড়াচ্ছেন। তারা একসাথে বিক্রি করে পিকনিক করবেন বলে কুঁড়াতে এসেছেন।
জয়পুর গ্রামের আবারুল বলেন, ৭/৮ দিন ধরে কুঁড়াচ্ছেন। প্রথম দিকে ৩/৪ ঘন্টা কুঁড়ায়ে ৪ মণ পর্যন্তও পেয়েছেন। তবে এখন কম পাচ্ছেন।
শিমলার আইট গ্রামের কয়েকজন নারী-পুরুষের সাথে কথা হয়। তারা বলেন, ভাটায় খালে পানি কমে যায়। তখন তুলতে সুবিধা হয়। প্রতিদিন ৩/৪ ঘন্টা পরিশ্রম করে অনেকে ৬/৭ শত টাকাও আয় করছে। যে যেমন তুলতে পারছে তার আয় তেমন হচ্ছে।
হুদুবনের হাফিজুল ইসলাম বলেন, এলাকা থেকে কিনে পাইকগাছায় ৩শ` থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা মণ বিক্রি করছি। এ খাল থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচশ ব্যক্তি ৮/৯ শ’ মণ ঝিনুক তুলছেন। তিনি বলেন, আগে কখনও এগুলো বিক্রি হতে দেখিনি। মাঝে মধ্যে কুঁড়াতে দেখতাম তবে তারা বিক্রির কথা স্বীকার করতো না। হঠাৎ ১০/১৫ দিন ধরে এ এলাকায় বিক্রি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। আর তখন থেকে খালে লোকে ভরে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ি দীর্ঘদিন ধরে শামুক ও ঝিনুক ক্রয় করেন। মূলত বর্ষার মৌসুমে বেশি পাওয়া যায়। সুন্দরবন থেকে শামুক-ঝিনুক কুঁড়িয়ে সেখানে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে উপকূলের বহু পরিবার।
এ বিষয়ে চাঁদখালী বাজারের এক ব্যবসায়ি জানান, তারা ৩৫০ টাকা মণ কিনছেন। এটা দিয়ে চুন তৈরি করে বিক্রি করছেন তারা। তবে বিস্তারিত কোন তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
সেখানকার ইউপি সদস্য মো: কাইয়ুম হোসেনের সাথে মোবাইল কথা হলে তিনি প্রথমে স্বীকার করেন চাঁদখালী বাজারের বেশ কিছু ব্যক্তি ঝিনুকের ব্যবসা করেন। তবে অজানা কারণে তাদের বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
কয়রা সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক বলেন, শামুক-ঝিনুক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এগুলোকে প্রকৃতির ফিল্টার বলা হয়। তবে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শামুক রয়েছে সেটা মাছ চাষের জন্য ক্ষতিকর। তিনি আরও বলেন, বণ্য প্রাণী নিধন আইনে প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে শামুক-ঝিনুক আহরণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অবৈধভাবে এ ব্যবসা করলে কিংবা প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে আহরণ করলে আইনানুযায়ি শাস্তির আওতায় আনা হবে।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগম বলেন, সমুদ্রের শামুক-ঝিনুক আহরণ ও ব্যবসা করা আইনত অপরাধ। চাঁদখালী বাজারে কেনাবেচার বিষয়ে তার জানা নেই। খোঁজ নিবেন বলে জানান তিনি।