বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর বারইখালী গ্রামের সুলতান মোল্লার মেয়ে রাবেয়া আক্তার(১৭) ওরফে আকলিমা। ৮ বছরের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে এসে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন মোরেলগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে। নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা বলতে গিয়ে অঝোরে কাদলেন ওই কিশোরী।
২০১৫ সালে একই গ্রামের জালাল হাওলাদার রাবেয়াকে নিয়ে খুলনার নিরালা এলাকায় পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম সামছুল হকের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজে দেন। এখানে ৫ বছর থাকার পরে রাবেয়াকে পাঠানো হয় সিলেটে সামছুল হকের মেয়ে তানিয়া সুলতানা লাকির বাসায়। এর তিন মাস পর সিলেট থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মিরপুরে ছোট মেয়ে নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায়।
লিজার বাসায় টানা তিন বছর গৃহপরিচারিকার কাজ করে শরীরে অসংখ্য আঘতের চিহ্ন নিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় বুধবার (৫ অক্টোবর) লিজার বাসা থেকে পালিয়ে মোরেলগঞ্জ আসেন। রাবেয়ার হতদরিদ্র পিতা সুলতান মোল্লা রোগাক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকায় তার চাচা কাঞ্চন মোল্লা রাবেয়াকে দ্রুত মোরেলগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
রাবেয়ার হাত, পা, মুখমন্ডল, পিঠ, পেটসহ গোটা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দৃম্যমান। চিকিৎসক ডা. রায়হানা ফেরদৌসি দোলা জানিয়েছেন রাবেয়ার শরীরে প্রচুর আঘাতের দাগ ও ক্ষত দেখা গেছে। তার সুস্থ হতে কয়েকদিন সময় লাগবে। সে হয়তো মানষিকভাবেও অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে।
চিকিৎসাধীন রাবেয়া বলেন, ‘৮ বছর ধরে গৃহপরিচারিকার কাজ করছি ওসি সামসুল হক ও তার দুই মেয়ে বাড়িতে। ৮ বছরে আমার পরিবারের কারও সাথে যোগাযোগ করতে দেয়নি তারা। মায়ের মৃত্যুর সংবাদেও ঘর থেকে বের হতে দেয়নি। প্রতিদিন দফায় দফায় মারপিট করে ঘরে বন্দি করে রেখেছে। কাজে একটু দেরি হলেই পিটিয়ে টিকটিকির বিষ্ঠা, তেলাপোকা ধরে মুখে তুলে ও বাচ্চাদের প্রসাব খেতে বাধ্য করেছে। ভাঙ্গা গ্লাস দিয়ে হাত ও মুখে আঘাত করে রক্তাক্ত করেছে। লাঠি দিয়ে পায়ের পাতা ও হাটুতে পিটিয়েছে। চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে মাথায় আঘাত করেছে। নিরুপায় হয়ে জীবন বাঁচাতে বুধবার পালিয়ে বাসে উঠে মোরেলগঞ্জে পৌছাই। রাবেয়া আরও বলেন আমার মায়ের শেষ স্মৃতি স্বর্ণের নাকের দুল আমাকে যেনো ওরা ফিরিয়ে দেয়।
রাবেয়ার চাচা কাঞ্চন মোল্লা বলেন, রাবেয়ার পিতা অক্ষম। কোন আয় নেই। পেটেরে দায়ে রাবেয়াকে পুলিশ কর্মকর্তা সামসুল হকের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজে দেওয়া হয়েছিল। ৮ বছর নির্মম নির্যাতনে কেটেছে তার দিন। এখন তাকে চিকিৎসা করিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়া হবে।
রাবেয়া পালিয়ে মোরেলগঞ্জে এসেছে এমন সংবাদ জেনে বুধবার বিকেলে ‘অবসরপ্রাপ্ত ওসি সামছুল হক’ মোরেলগঞ্জে রাবেয়াদের বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি রাবেয়ার চিকিৎসা খরচ বাবদ নগদ ৫ হাজার টাকা দেন বলেও রাবেয়ার চাচা কাঞ্চন মোল্লা জানান।
কাঞ্চন মোল্লার দেওয়া তথ্য ও মোবাইল নম্বর অনুযায়ী ফোন করা হলে পরিচয় পাওয়া যায় সামছুল হকের। সামছুল হক সর্বশেষ বাগেরহাটের শরণখোলা থানার ওসি থাকাকালে অবসর গ্রহণ করেছেন বলে জানান। বর্তমানে খুলনায় থাকেন। রাবেয়াকে তার বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজে নেওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘রাবেয়া আমার মেয়ের বাসা থেকে অনেক মালামাল নিয়ে গত বুধবার পালিয়ে গেছে। মিরপুর থানায় জিডি করা হয়েছে। আপনারা শীঘ্রই মোরেলগঞ্জ থানার মাধ্যমে মেইল পেয়ে যাবেন’।
সাবেক ওসি সামছুল হক আরও বলেন, ‘রাবেয়া পালিয়ে গেছে এ খবর পেয়ে আমি গত বুধবার মোরেলগঞ্জে গিয়ে শুনেছি, আমার মেয়ে রাবেয়াকে মারধর করেছে তাই মানবিক কারনে তার চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি’।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাবেয়ার বিষয়টি তিনি অবহিত নন। তবে, তার চিকিৎসা ব্যবস্থার খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।
খুলনা গেজেট/এসজেড