‘শেষ সীমানার স্কুল। উপজেলা সদর থেকে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। দূরের স্কুল মাঠের খেলা গুলোতে অংশ গ্রহণ করতে ওদের খুব কষ্ট হতো। তাই মনে মনে ভাবতাম দল ঠকে যাক। কিন্তু গোল দিয়ে ওরা যখন বিজয় উল্লাসে মাঠ দাপিয়ে বেড়ায় তখন মনে হতো কিসের কষ্ট। যে ভাবে হোক ওদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কারণ আমার ছেলেরা অদম্য। আর অদম্য বলেই ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের খেলায় চ্যাম্পিয়ানশীপ অর্জন করেছে।
এবারের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে বাগেরহাট হয়ে খুলনা বিভাগীয় মাঠে খেলবে জেলার সাড়ে এগারো শ’ স্কুল সেরা ক্যাপ্টেন মিরাজের ফুটবল দল। কিন্তু প্রত্যন্ত পল্লীর ক্ষুদে খেলোয়াড়দের এতবড় অর্জনের পরও কোন খোঁজ-খবর নেননি স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা।’ বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আক্ষেপের সাথে এভাবে বিজয়ের বর্ণণা দিচ্ছিলেন বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার ১০১ নং খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও দলের কর্মকর্তা মোঃ জিন্দার আলী মোল্লা।
তিনি আরও জানান, চলতি বছরের ১৫ জুন এবারের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়। শুরুতে (বড়বাড়িয়া) ইউনিয়ন পর্যায়ে ২১ টি স্কুলের অংশ গ্রহণে খেলা হয় বড়বাড়িয়া (হাটখোলা) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। ৫ টি দলের সাথে খেলে ১৮ জুন ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলায় হাড়িয়ারঘোপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দলের সাথে খেলে ৩-১ গোলে জয়লাভ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ান হয় খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্যাপ্টেন মিরাজের দল।
চিতলমারী উপজেলা পর্যায়ের খেলা হয় শিবপুর (ইউনিয়ন পরিষদ) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। ৭ টি ইউনিয়নের মোট ৪ টি দলের সাথে খেলা হয়। ২১ জুন পাঁচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে খেলে ৩-১ গোলে জয়লাভ করে উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ান হয় খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দল।
বাগেরহাট জেলা পর্যায়ের খেলা হয় বাদেকাড়াপাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতি খেলার মাঠে। মোট ৯টি উপজেলার ৩ টি দলের সাথে খেলে ২২ জুন মোড়েলগঞ্জ উপজেলার গাবখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দলকে হারিয়ে ৩-২ গোলে জয়লাভ খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্যাপ্টেন মিরাজের ফুটবল একাদশ। এখন অপেক্ষায় জেলার হয়ে খুলনা বিভাগের মাঠে খেলা ও ভাল কিছু করার। কিন্তু গ্রামাঞ্চল থেকে অতদূরে ছোট্ট খেলোয়াড়দের নিয়ে খেলায় রয়েছে নানা বাধা বিপত্তি। শেষ পর্যন্ত ওরা বিভাগীয় খেলায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে নানা সংশয়। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আশ্বাসে তাঁরা আশায় বুক বেধে আছেন বলেও উল্লেখ করেন ওই প্রধান শিক্ষক।
খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল একাদশের টিম ম্যানেজার ও সহকারি শিক্ষক মোঃ হাবিবুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়টি একেবারে অজপাড়াগায়ে। উপজেলা সদর হতে শেষ সীমানা। এখানের অধিকাংশ মানুষই কৃষক ও দরিদ্র দিনমজুর। ওইসব পরিবারের সন্তানরা আমাদের স্কুলের ছাত্র। সেই সব দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিয়েই আমাদের ফুটবল টিম। দূর-দূরান্তের মাঠে ওদের নিয়ে খেলতে গিয়ে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। সব কিছুকে পিছু ফেলে ওরা জয়ের মালা ছিনিয়ে আনলেও পাইনি স্থানীয় ভাবে কোন মর্যদা।
খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল একাদশের কোচ ও সহকারি শিক্ষক সত্যজিৎ রায় বলেন, ‘আমাদের স্কুলের মাঠ ছোট। খেলার পরিবেশ নেই। তাই ওদের কোচ দিয়েছি পাশের একটি মাঠে। মাঠে অনুশীলনের সময় ওরা কঠোর পরিশ্রম করেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় খাবার খেতে পারেনি। খাবে কি ভাবে ওরা সকলেই একেবারে নিম্মবিত্ত পরিবারের। টাকার জন্য আমার বেষ্ট প্লেয়ার মিরাজ মানুষের ভ্যান ঠেলে দিচ্ছে। তা দিয়ে কিছু আয় করে মিরাজ খেলার পিছনে ব্যয় করছে। অথচ এই মিরাজ মাঠে দুর্দান্ত খেলে। বিষয়টি আমাকে দারুণ কষ্ট দিয়েছে। কোচ হিসেবে আমি চাই ওরা যেন বিভাগে খেলতে পারে এবং ওদের প্রতিটি প্লেয়ারের এ খেলা অব্যাহত থাথে। হয়তো ওদের মধ্যে কেউ একদিন ফুটবলে বাংলাদেশের নাম উজ্বল করবে।’
খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একাদশের খেলোয়াড়রা হলেন, মিরাজ মীর (ক্যাপ্টেন), মাহামুদুল হাসান (গোল কিপার), মোঃ তামিম মোল্লা (ডিফেন্স), আবু বক্কর (ব্যাক), ইসমাইল মোল্লা (মিডিল মাঠ), জয় (ডিফেন্স), শান্ত (লাইনে), আলিফ মোল্লা (ডিফেন্স), রোহান মোল্লা (লাইনে), মোঃ ছানাউর (মিডিল মাঠ), আব্দুল্লাহ শেখ (ডিফেন্স), রাব্বি মোল্লা (ডিফেন্স), মাহমুদ (অতিরিক্ত), শ্রাবণ (অতিরিক্ত) ও ইউসুফ শেখ (অতিরিক্ত)।
খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দলপতি ও পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র মিরাজ মীর বলেন, ‘আমাদের গ্রাম থেকে গিয়ে শহর লেভেলে খেলতে হয়। অনেক সমস্যা রয়েছে। আমরা চাই আমাদের এই খেলা যেন মাঝ পথেই থেমে না যায়। তাহলে আমাদের স্বপন ভঙ্গ হবে।’
চিতলমারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাগেরহাট জেলায় মোট ১১৬২ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও চিতলমারী উপজেলার খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌকস খেলোয়াড়রা বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২২ বাগেরহাট জেলায় চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের। বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে তারা এ খেলা অব্যাহত রাখবে বলে আশা করি।’
চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাইয়েদা ফয়জুন্নেছা বলেন, ‘খাগড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জয় আমাদের জন্য আনন্দের। ওদের কয়েটি খেলা আমি দেখিছি। ওরা খুবই ভাল খেলে। বিভাগীয় পর্যায়ের খেলায় অংশ গ্রহণের জন্য আমরা ওদের সহযোগিতা করব।’
খুলনা গেজেট/এসজেড