অন্যান্য বছরের ন্যায় এ বছরও পুরো সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব আলঝেইমার’স ডিজিজ সচেতনতামূলক মাস। এই রোগে প্রধাণত মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং রোগটি স্মৃতিভ্রংশের অন্যতম সাধারণ একটি রূপ হিসাবে বিবেচিত। ১৯০৬ সালে জার্মান মনোবিজ্ঞানী অ্যালয়েস আলঝেইমার প্রথম এই রোগটি বর্ণনা করেন। সাধারণত ৬৫ বছর বয়সের বেশি লোকেরা এই রোগে আক্রান্ত হন। যদিও আলঝেইমারের প্রারম্ভিক সূত্রপাত এর বেশ আগেও হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০৫০ সালের মাঝে বিশ্বের প্রতি ৮৫ জনের ভিতরে ১ জনেরই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কারণ:
আলঝেইমার রোগের প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা এখনও সম্ভব হয়নি। তবে ৫-১০% ক্ষেত্রে বংশগতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এই রোগে আক্রান্তের মস্তিষ্কে তিনটি উপাদানের অস্বাভাবিক উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, যেমন – অ্যামাইলয়েড প্লাক (অ্যামাইলয়েড বিটা নামক একধরনের প্রোটিন উৎপাদনের মাধমে পরবর্তীতে মস্তিষ্কের রক্তকণিকার ভেতরে দলা পাকিয়ে অ্যামাইলয়েড প্লাক গঠিত হয় যা প্রদাহ ও জারণ ক্রিয়ায় নিউরনের মৃত্যু ঘটায়), নিউরোফিব্রিলারি ট্যাঙ্গল (যা হাইড্রোফসফোরাইলেটেড টাউ প্রোটিনের সমষ্টি এবং নিউরনের সক্রিয় রক্তনালীর পরিমাণ কমিয়ে দেয়) এবং অ্যাসিটাইলকোলিন নামক রাসায়নিক বার্তাবহ।
লক্ষণ:
এই রোগের লক্ষণ বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়। এসত্ত্বেও কিছু কিছু সাধারণ উপসর্গ রয়েছে যা অধিকাংশ রোগীর মাঝেই প্রকাশ পায়। প্রাথমিক উপসর্গগুলোকে প্রায়শই বার্ধক্যজনিত সমস্যা বা মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ বলে ভুল করা হয়। প্রারম্ভিক অবস্থায় প্রকাশিত উপসর্গ সমূহের সবচেয়ে সাধারণ রূপ হল সাম্প্রতিক ঘটনা ভুলে যাওয়া কিন্তু অতীতের ঘটনার পূর্ণ স্মৃতিচারণ। এছাড়া আচরণ পরিবর্তনের উপসর্গও থাকতে পারে। এ রোগে আক্রান্তরা সহজেই বিরক্ত হয়ে যান, প্রায়ই হতাশা দেখা দেয় এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এর ফলে দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং নতুন কোনো কাজের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে রোগী নিজে নিজের যত্ন নিজে নিতে পারেন না, নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী কাউকেই চিনতে পারেন না, কারও কথাবার্তা বোঝার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন, গোসল করা, টয়লেট করা, কাপড় পরা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি কারও সাহায্য ছাড়া করতে পারেন না, দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চিনতে পারেন না, খাবার গ্রহণ করার পরপরই তা ভুলে যান, হাঁটাচলা করতেও সমস্যা হয়। এ সময় রোগীর সংক্রমণ, জ্বর, ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতা, ডিহাইড্রেশন ইত্যাদিও দেখা দিতে পারে। রোগের অবনতির সাথে সাথে রোগী দ্বিধাগ্রস্থতা, অস্থিরতা, রোষপ্রণতা, ভাষা ব্যবহারে অসুবিধা, দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিভ্রংশতা এবং ক্রমান্বয়ে শারীরিক ক্রিয়াকর্মের বিলুপ্ততা ও অবশেষে মৃত্যু মুখে পতিত হন।
চিকিৎসা:
দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখনো পর্যন্ত এ রোগের কোন প্রতিকার নেই। এর চিকিৎসা রোগের লক্ষণ ও উপসর্গের উন্নতি সাধন এবং রোগের বিস্তার প্রতিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আক্রান্ত রোগীর যথাযথ যত্ন নিতে হবে এবং তাকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। রোগীর সেবাযত্নের জন্য দরকার সর্বক্ষণিক সাহায্যকারী। রোগীকে পছন্দের কাজ করতে দেওয়া, পছন্দের গান শোনানো, ব্যায়াম করানো, আপনজনদের সঙ্গ বেশি পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, পছন্দের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, প্রিয় লেখকের বই পড়ে শোনানো, শখের কাজ করতে দেওয়া যেমন বাগান করা, থাকার ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে রোগীর যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করা যায়।
লেখক : এমবিবিএস (ঢাকা মেডিকেল কলেজ), বিসিএস (স্বাস্থ্য), মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডুমুরিয়া, খুলনা।