শুরুতেই পাঠকের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন। শিল্পী ছাড়া শিল্পকর্ম অথবা চিত্রকর ছাড়া একটি চিত্র কি সম্ভব? স্থপতি ছাড়া স্থাপত্য, ভাস্কর ছাড়া ভাস্কর্য বা ডিজাইনার ছাড়া কোন ডিজাইন কি সম্ভব? বুদ্ধিমত্তা বা ইনটেলিজেন্স ছাড়া কি ডিজাইন সম্ভব? ধরুন এই অনলাইন পোর্টালের ওয়েভ ডিজাইন বা প্রোগ্রামের কথা। এটা কি ডিজাইনার বা প্রোগ্রামার ছাড়া এমনি এমনি হয়ে গেছে? সহজ, সোজাসাপটা উত্তর, কস্মিনকালেও না। কেউ কেউ বা বলবেন, এগুলো কোন পশ্ন হলো। মাথা খারাপ নাকি? কিন্তু বাস্তবে আমরা আম জনতা, এমনটি অনেক ঝানু ঝানু বিজ্ঞানীরাও এখানে এসে বিভ্রান্ত হন। গেঁয়ো ভাষায় বলতে গেলে ধরা খান। এ সময় আমাদের বুদ্ধিটা কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যায়, মরিচা পড়ে যায় ক্ষুরধার মগজের মাথায়। চোখে ছানি পড়া রোগীর মতো আমরা আর সত্য কিছুই দেখতে পাই না । অনেক বিজ্ঞানী (তবে সবাই নয়) এই কাল্পনিক মতবাদে বিশ্বাসী যে বিশ্ব-ব্রমান্ডের সকল ডিজাইন, আকার-আকৃতি ও গঠণপ্রকৃতি কাকতালীয়ভাবে দৈবচয়ন বা র্যানডাম প্রক্রিয়ায় অকস্মাৎ হয়ে গেছে। কেউ কেউ একটু আগ বাড়িয়ে বলেন, লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি বছর ধরে ঘুরতে ঘুরতে নাকি প্রাণীজতের সকল আকার বা ডিজাইন গুলো নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। নিজে নিজেই সৃষ্টি হওয়া বা তৈরি হওয়া, এ আবার কেমন উদ্ভট কথা? স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি, ডিজাইনার ছাড়া ডিজাইন; পাঠক বলবেন, এটা কি কোন গাঁজাখোরি কথা!
পাঠক, একটি কথা জেনে রাখা দরকার, প্রকৃত সত্য (Fact), বিজ্ঞান (science), বৈজ্ঞানিক তথ্য (scientific Informanation) এবং বৈজ্ঞানিক মতবাদ (scientific theory) কিন্তু এক জিনিষ নয়। বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং বৈজ্ঞানিক মতবাদ স্থির বা নিরেট কোন বিষয় নয়, যে কোন সময়ে তা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সম্পূর্ণ বাতিল হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য বা সত্য সাধারণত পরিবর্তন হয় না। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও সহজ হবে। এক সময় বিজ্ঞানীরা এই মতবাদে বিশ্বাস করতেন যে, সূর্য স্থির আর পৃথিবী ঘুরছে। কিন্তু যা প্রকৃত সত্য তা অধুনা আবিষ্কৃত হয়েছে। এখন সবার কাছে এটা পরিষ্কার যে, সূর্য এবং পৃথিবী সবই তার নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরছে, কেউই অলস বসে নেই। বিজ্ঞানীরা কিছুদিন আগেও এটা বিশ্বাস করতো যে, বস্তুর সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শুধু এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থানে রুপান্তর হয় মাত্র। কিন্তু সম্প্রতি এ তথ্য ভূল প্রমানিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দিতে ডারউইনসহ অনেক বিজ্ঞানীই ‘blending inheritance’ থিওরীর প্রবক্তা ছিলেন।
কথ্য ভাষায়, এটা অনেকটা আমাদের দেশের খিচুড়ী থিওরীর মত। চাল ও ডাল মিলে তৈরি হয় খিচুড়ী, যাকে চালও বলা যায় না, আবার ডাল নামেও অভিহিত করা যায় না। এই থিওরী বা মতবাদের মূল কথা হলো, প্রাণীর বৈশিষ্ট তার পরবর্তী বংশধরের মধ্যে রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় এবং সন্তানের বৈশিষ্ট সব সময় মাতা-পিতার মাঝামাঝি হয়। কিন্তু মেন্ডেলের জেনেটিক্স আবিস্কারের পরে এই থিওরীএকেবারেই ভূল সাব্যস্থ হয়। এরকম হাজারো বৈজ্ঞানিক থিওরী বাতিল হয়েছে যা লিখলে কয়েক খন্ড বই ছাপানো যাবে।
এটাই ধ্রুব সত্য যে, কোন ডিজাইনই ডিজাইনার ছাড়া সম্ভব নয়? আর ডিজাইন করতে হলে বা ছবি অঙ্কন করতে হলে অবশ্যই বুদ্ধিমত্তা বা ইনটেলিজেন্স প্রয়োজন হবে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানব-সৃষ্ট বস্তু, চাই তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার পিছনে কেউ কেউ না নির্মাণকারী বা প্রণেতা আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক হাজারো আকার এবং জিজাইনের যে সকল জীব আমরা দেখি তার কি কোন সৃজনকর্তা নেই? হরেক রকম ফুল, ফুলের সুবাস, ফুলের জিজাইন এগুলো কি খামাখা খামখিয়ালিভাবেই হয়ে গেছে? এখানে কেন আমরা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করি। কেন আমাদের ঘিলু এই সময় কাজ করে না? কেন আমরা জ্ঞানপাপী হয়ে যায়? কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে খুব বেশী মগজের দরকার হয় না। তাহলে কি এক শ্রেণীর বিজ্ঞানী গো-ধরে আছে যে, কোন ভাবেই তারা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করবে না? কথায় বলে, ১০টি তৃষ্ণার্ত ঘোড়াকে একজনে পানি পান করাতে পারে, কিন্তু ১০ জনে মিলেও একটি অপিপাসীত ঘোড়াকে পানি পান করাতে পারে না। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করলে অসুবিধাটা কোথায়? এতে কি বিজ্ঞানশাস্ত্র অচল হয়ে যাবে, কিংবা বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব মাঠে মারা যাবে? কখনই নয়। হাজারো প্রথিতযশা বিজ্ঞানী আছে যারা সৃজনকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। বরং তারা নাস্তিক মতবাদের প্রতিবাদ করেছে এবং এই তত্ত্বের প্রবক্তা যে, প্রকৃতির জটিল ডিজাইন কোনভাবেই বুদ্ধিমত্তা বা ইনটেলিজেন্স ছাড়া সম্ভব নয়। তবে কোন সে সত্ত্বা, তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
বর্তমান জামানা হলো জেনেটিক্স ও বায়োটেকনোলজীর যুগ।
সম্প্রতি জেনোম সিক্যুয়েংসিংয়ের মাধ্যমে সম্পুর্ণ জেনোম তথ্য জানা গেছে অনেক জীবের। এখন উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন রহস্য ও জীবনতত্ত্ব জানা যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহের ভিতরকার বিষ্ময়কর ডিজাইন, সুন্দর কাঠামো, সুপ্রতিষ্ঠত নিয়ম-শৃঙ্খলা ও কার্যপ্রণালীর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। জীবের প্রতিটি অঙ্গের গঠন, আকার ও জিজাইন কেমন হবে তা পূর্ব থেকেই খোদাই করা আছে কোষের ডিএনএ-র মধ্যে। একে বলা হয় জেনেটিক কোডিং সিসটেম। খামখেয়ালীভাবে বা দৈবিকভাবে কোন কিছুই ঘটছে না। যদি ডারউইনের তত্ত্ব অনুসারে সকল জীব কাকতালীয়ভাবে দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় হতো তাহলে পৃথিবী ও জীবসম্প্রদায় অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেতো। কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। পাঠক, একটু আপনার দেহের দিকে লক্ষ্য করুন। বলুনতো আপনার দেহে কতটি গ্রন্থি, অস্থি, অঙ্গ-প্রতঙ্গ আছে? কোষের সংখ্যা, জীনের সংখ্যা না হয় নাই জিজ্ঞাস করলাম। আমরা আম জনতা তো দূরের কথা; বিজ্ঞানী, গবেষক, বিশেষজ্ঞ, তারাও সঠিকভাবে বলতে পারবেন না এগুলোর সঠিক সংখ্যা কতো। তাদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর মতভেদ। আমাদের দেহে প্রধান প্রধান অঙ্গের মধ্যে রয়েছে হাত, পা, চোখ, কান, নাক, মাথা, হৃৎপিন্ড, লিভার, কিডনি, ফুসফুস, শ্বসন তন্ত্র, পরিপাক তন্ত্র, রেচন তন্ত্র, পরিবহন তন্ত্র, রক্ত সঞ্চালন তন্ত্র, জননতন্ত্র, আরও নাম না জানা অনেক অঙ্গ-প্রতঙ্গ। প্রত্যেকটি অঙ্গ এবং তন্ত্রের মধ্যে আবার রয়েছে অসংখ্য প্রতঙ্গ বা শাখা-প্রশাখা। ধরা যাক চোখের কথা। এর মধ্যে আছে কয়েক ডর্জন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যেমন, চোখের পর্দা, ভুরু, চোখের মনি, আলো-প্রবেশ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র, কর্নিয়া, লেন্স, চোখের গোল চেম্বার, অপটিক নার্ভ, রেটিনা বা ছবির পর্দা, নেগেটিভ ছবির ধারক, ছবি ব্রেনে পাঠানোর নার্ভ বা কেবল, ছবি প্রসেসের জন্য সিপিইউ বা সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট বা ব্রেন, নেগেটিভ ছবি থেকে পজিটিভ ছবি বানানোর যন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো সাধারণ কোন জিনিস নয়, যেন এক একটা ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরি বললেও কম বলা হবে। কারণ দুনিয়ার যে কোন ফ্যাক্টরি থেকে তা হাজারো গুণ জটিল এবং স্পর্শকাতর। তবে এ সমস্ত ফ্যাক্টরি গুলো খুবই সু-শৃঙ্খলভাবে নিপুণতারসাথে চলছে। কোথাও কোন গড়মিল নেই।
পাঠক, হিসেব সহজের জন্য ধরে নিলাম আমাদের দেহে ১০টি প্রধান অঙ্গ বা তন্ত্র এবং প্রত্যেকটির আবার ১০ টি করে প্রতঙ্গ আছে। অর্থাৎ ১০*১০ বা ১০০টি অঙ্গ-প্রতঙ্গ আছে। এসমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো যখন আমাদের দেহে মায়ের পেটে সেট করা হচ্ছে তখন তা সুনিপুণভাবেই হচ্ছে। নিখুতভাবে অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো একটির পর একটি সাজানো হচ্ছে। কোনরুপ কাকতালীয়তা বা এলোমেলোভাব নেই। ডারউইন ও তার অনুসারী বিজ্ঞানীদের মতে যদি এগুলো দৈবচয়ন বা র্যানডন প্রক্রিয়ায় হতো, তাহলে মিলিয়ন কেন, বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরেও তা সম্ভব হতো না। তবুও যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো প্রাকৃতিকভাবে, কোনরুপ বুদ্ধিমত্তা বা ইনটেলিজেন্সের পূর্ব হস্তক্ষেপ ছাড়াই তৈরি হচ্ছে এবং সুবিন্যস্তভাবে পরপর জোড়া লেগে যাচ্ছে।
তাহলে আসুন আমরা পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের মাধ্যমে এটার সম্ভাবনা যাচাই করি। জেনে রাখা ভালো, বৈজ্ঞানিক যেকোন তথ্য গ্রহণ করতে হলে তার সম্ভাবনার ব্যাপারে আমাদের ন্যূনতম ৯৫% নিশ্চিত হতে হবে, অর্থাৎ ৫% ভূল ছাড় দেওয়া যাবে। এখন আসা যাক আসল সম্ভাবনা টেস্টে। হিসেব সরলীকরণের জন্য আমরা ধরে নিয়েছিলাম আমাদের দেহে ১০০ টি বিভিন্ন আকার ও ডিজাইনের অঙ্গ-প্রতঙ্গ আছে। পরিসংখ্যানের পারমুটেশন বা বিন্যাস সূত্র অনুযায়ী এই ১০০ টি অঙ্গকে আমরা প্রায় 9×10157 (৯ সংখ্যার পর ১৫৭ টি শুন্য বসাতে হবে) ভাবে সাজাতে পারি। অর্থাৎ অঙ্গ-প্রতঙ্গ গুলো ঠিক আমাদের দেহে যেভাবে সাজানো আছে সেভাবে পাওয়ার সম্ভাবনা ০.০০০০০০০০…..০০০১% (পয়েন্টের পর ১৫৫ টি শুন্য)। অর্থাৎ দৈবচয়ন বা র্যানডন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের বর্তমান গঠন পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
এক হিসেব মতে আমাদের দেহে ২০৯ টি অস্থি বা হাড় এবং ৩৬০ টি গ্রন্থি আছে। এখন আমরা চিন্তা করি এই ২০৯ টি হাড় এবং ৩৬০ টি গ্রন্থিকে কতভাবে সাজানো যায়, এবংআমাদের দেহে যেভাবে সাজানো আছে সেভাবে পাওয়ার সম্ভবনা কত । পাশে সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর থাকলে একটু কষ্ট করে বিনাস বাটনে চাপ দিন। এই রেজাল্টই আমাদেরকে বলবে যে, বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পার হলেও দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় বা র্যানডনভাবে দেহের বর্তমান গঠন পাওয়া সম্ভবপর নয়। আসলে, দৈবচয়ন বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাগুলো নেহায়েত কাল্পনিক এবং মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সম্প্রতি জেনেটিক্স ও জেনোম তথ্যের মাধ্যমে জানা গেছে যে, আমাদের দেহে গড়ে প্রায় ৩৭.২ ট্রিলিয়ন (৩৭,২০০,০০০,০০০,০০০) কোষ আছে। তুলনা করলে পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তার প্রায় ৪৯৬০ গুণ। প্রতিটি কোষে আছে২৩ জোড়া ক্রোমোজোম। ক্রোমোজোম গুলোর ভিতরে আছে ২০ হাজারেরও বেশী জীন। এই সমস্ত জীনের ভিতর অত্যন্ত সুচারুভাবেও সুপরিকল্পিতভাবে খোদাই করা আছে প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের আকার-আকৃতি, গঠন-প্রকৃতি, কার্যপ্রণালীসহ সকল প্রকার তথ্য। এটাকে বলা হয় জেনেটিক কোডিং বা ভবিষ্যৎ বৈশিষ্ট্যের নকশা। সাধারণত অনেকগুলো এ্যামাইনো এসিড (১০০ এর কম নয়) পরপর যুক্ত হয়ে প্রোটিন তৈরি হয় যা জীবের সকল জৈবিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এক একটি এ্যামাইনো এসিড কেমন হবে তা আবার তিন অক্ষরের কোডিংয়ের সাহায্যে ডিএনএর মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। যদি এই সমস্ত এ্যামাইনো এসিডগুলো জীব দেহে কাকতালীয়ভাবে সংযুক্ত হতো তাহলে অনেক আগেই পৃথিবীর সমস্তজীব চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। একটি রোগ আছে যার নাম প্রজেরিয়া। এটি একটি বিরল রোগ। এ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে মাত্র ১৪০ জনের মতো এ রোগী পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে পাওয়া গেছে মাত্র ২ জন।
কয়েক বছর আগে পত্রিকাতে খবর এসেছিল যে, মাগুরায় এই রোগী পাওয়া গেছে। তার নাম বায়েজিদ। এ রোগ হলে ৩/৪ বছরের বাচ্চাকে দেখতে ৭০/৮০ বছরের বুড়োর মতো মনে হবে। এই রোগের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো,এই রোগী সাধারণত ১৫ বছরের বেশী বাঁচে না। পত্রিকায় যখন এই রোগের খবর প্রকাশিত হয় তখন আমি পিএইচডির কাজে অস্ট্রেলিয়া ছিলাম। যেহেতু আমি জেনেটিক্স ও জীনের প্রকাশ নিয়ে গবেষণা করছিলাম, তাই আমার কৌতূহল হলো এই রোগের আসল কারণ জানার জন্য। প্রকাশিত গবেষণা পত্র খুজে দেখলাম, প্রায় ১৮৪৮ বেজ-পেয়ার লম্বা LMNA জীনের ১৮২৪ নং পজিশনে মাত্র ১ টি নিউক্লিওটাইড (Cytosine এর পরিবর্তে Thymine) পরিবর্তন হওয়ার কারণে এই এ্যাবনরমালিটি সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে জেনেটিক্সের ভাষায় বলা হয় পয়েন্ট মিউটেশন। এটাকে ব্যাতিক্রমি ও বিরল ঘটনা বা এ্যাবনরমালিটি হিসেবেই ধরা হয়। এই জিনটিতে কমবেশী ১৮৪৮ টি নিউক্লিওটাইড আছে। সহজ ভাষায় ACTG এই রকম ১৮৪৮ টি অক্ষর পরপর সাজানো আছে যার ভিতর মানুষের কোষ বৃদ্ধির একটা পূর্ব নির্দেশনা বা ছক খোদাই করা আছে। এটি খুবই পরিকল্পিত যা দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে।শুধু এই একটি জিনই নয়, এরকম আরও শতশত জিন আমাদের দেহে আছে যেগুলো সম্বিলিতভাবে আমাদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও গঠননিয়ন্ত্রণ করে।
এখন পাঠক একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন, একটি অক্ষরের পরিবর্তনে যদি আমাদের দেহে এত বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সমস্ত অক্ষরগুলো যদি ডারউইনপন্থী বিজ্ঞানীদের মতে কাকতালীয়ভাবে দৈবচয়ন বা র্যানডন প্রক্রিয়ায় হতোতাহলে আমরা অনেক আগেই দুনিয়া থেকে বিলীন হয়ে যেতাম।মোদ্দা কথা, সমস্ত জীবজগত কখনই অস্তিত্বে আসতো না।
বিজ্ঞানের শিশুবেলাতে এক শ্রেণীর বিজ্ঞানী এই ধারণা করতো (হয়তবা এখনও কেউ কেউ করেন) যে, কোটি-কোটি বছর আগে কাকতালীয়ভাবে র্যানডন প্রক্রিয়ায় অকোষী ও এক কোষী অণুজীব ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয়। এরপরলক্ষ-লক্ষ বছর ধরে ঘুরতে ঘুরতে নানাপরিবর্তনের মাধ্যমে এক কোষী থেকে দোকোষী, দোকোষী থেকে বহুকোষী, এভাবে আচ্ছে আচ্ছে, ধীরে ধীরে আজকের এই জীববৈচিত্রের উৎপত্তি। কিন্তু বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগে তাদের এই মতবাদ হালে পানি পাচ্ছে না।
অনেক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী এর প্রতিবাদ করেছেন এবং প্রমান করেছেন যে, সমস্ত জীবই, তা ছোট হোক বা বড় হোক, এক সুক্ষ ও জটিল ডিজাইনের মাধ্যমে হচ্ছে। এর পিছনে রয়েছে এক সীমাহীন বুদ্ধিমত্তা বা ইনটেলিজেন্সের ছাপ। খুবই ক্ষুদ্র এক অণুজীব ব্যাকটেরিয়ার দেহের সৃষ্টিকৌশল ও গঠণ আবিস্কৃত হয়েছে। দেখা গেছে এটি কোন ভাবেই সরল কোন জীব নয়। এর চলার অঙ্গ বা ফ্লাজেলার গঠণ মানব-সৃষ্ট স্পিড বোট বা জাহাজের প্রপেলারের চেয়েও ঢের জটিল এবং স্পর্শকাতর। এর পরতে পরতে রয়েছে কোন এক প্রকৌশলীর দক্ষ হাতের নিপুন ছোঁয়া। হাতে সময় থাকলে, একটু কষ্ট করে হলেও ব্যাকটেরিয়ার ফ্লাজেলার ভিতরকার গঠণকৌশল ও মানব-সৃষ্ট প্রপেলারের গঠনের ছবি পর্যবেক্ষণ করুন। আপনার মন এমনিতেই বলে উঠবে, এটা কাকতালীয়ভাবে কস্মিনকালেও সম্ভব না।
শুধু এই ব্যাকটেরিয়া নয়, আমাদের চারপাশে পৃথিবীর কোন একটি জীবের দিকে নিরপেক্ষ ও ভাবুক মন নিয়ে তাকাই। নজর করি হরেক রকম ফুল-ফল, মনোহর জীববৈচিত্র আর অগণিত সৃষ্টির দিকে।প্রতিটি অণু-পরমাণুতে দেখতে পাব এক মহান সত্ত্বার সীমাহীন শক্তির বহিঃপ্রকাশ আর সুদক্ষ হাতের নিপুন কারুকার্য। শুরু করেছিলাম কয়েকটি প্রশ্ন দিয়ে, শেষ করব আর একটি ছোট্ট প্রশ্ন রেখে, পাঠক বলুনতো কে সে জন? মহান আল্লাহ তায়ালা উত্তর দেন, তিনিই আল্লাহ যিনি আসমান ও জমিন এবং মধ্যকার সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে (আল কুরআন)।
লেখক : আণুবিক জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, yousufku@gmail.com
খুলনা গেজেট/এআইএন