সুন্দরবনে মাছ কাকড়া ধরে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা খরচ ও সংসার চালিয়ে ভালোই চলছিলো উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরি গ্রামের অলোকা রানীর। অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে ৩ কাটা জমি কিনে ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের কিছু দিন আগে নতুন ঘর তৈরি করছিলেন। ঘরের কাজ শেষ না হতে হানা দেয় ইয়াস। ঘরবাড়ি, গরু, ছাগল, সহায়-সম্পদ সবকিছুই ভাসিয়ে নেয় শাকবাড়িয়া নদীর ফুঁসে ওঠা জল। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কোন রকমে নিজেদের জীবন বাঁচিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন স্বপ্নের ঘরসহ সব কিছু কি ভাবে ভেসে যাচ্ছিলো। দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিলনা তার। সব কিছু হারিয়ে রাস্তার উপর খুঁপড়ি বেঁধে বসবাস করছিলেন। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাই বাঁধ হওয়ার পরে ঘর বাঁধার মতো একটু জায়গা থাকলেও নতুন ঘর বাঁধার সক্ষম না থাকায় সেখানে কোন রকমে দোচালা খুপড়ি বেধে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে রয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে তার মেয়ে শ্যামলীকে বের করে দেয় তার জামাই। নিরুপায় হয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তার কাছে।
তিনি আরও বলেন, ৪ বিঘার মত সম্পত্তি ছিলো তার স্বামীর। ২০০৯ সালে ২৫ মে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় আইলায় তাদের ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। প্রতিদিন যুদ্ধ করার থেকে মরণডা ভালো দুঃখভরাক্রান্ত মন নিয়ে এমন মন্তব্য করেন তিনি ।
একই গ্রামের শেফালী দাস। তিনিও ছোট্ট একটি ঘরে বাসকরছেন। তার চোখের সামনেও সব কিছু ভেসে গেছিলো। দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিলেনা। তার কোলের ছোট্ট শিশুকে দুপুরে খেতেও দিতে পারেনি সেদিন। তাড়াহুড়া করে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। চোখের সামনে তার ঘরটা জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। ২ দিন না খেয়ে ছোট্ট শিশুকে নিয়ে খোলা রাস্তার উপর বসবাস করেছেন। এর পর পাশের গ্রাম থেকে তার এক আত্মীয় খাবার দিলে তার ছোট্ট শিশুকে খেতে দেন।
ইয়াসের সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে আরেক সর্বশান্ত তপন মন্ডল। তার সংসার চলতো দিনমজুরি ও সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরে। বাঁধের ধারে একটি ছোট্ট ঘরে স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। ইয়াসের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে তার ঘরটি জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। সব কিছু হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার কাঁকড়া ধরা নৌকায়। ৫ দিন পর বেড়িবাঁধে একটি দোচালা ঘর বাধেন। এর আগে ২০০৯ সালে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় আইলায় তাদের সবটুকু জায়গা নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
অলোকা রানী, শিফালী রানী ও তপন মন্ডলের মতো কয়রা উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিঃস্ব হচ্ছে। ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে খুলনার কয়রা উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নের প্রায় ১২ টি পয়েন্ট ভেঙে প্লাবিত হয় অর্ধশতাধিক গ্রাম।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে প্রবল জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণ পানিতে তলিয়ে যায় উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ৫০ টি গ্রাম। ঘূণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার অতিমাত্রায় জোয়ারের পানিতে উপজেলার শাকবাড়ীয়া ও কপোতাক্ষ নদীর প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করে। বিধ্বস্ত হয় ১২৫০ টি ঘর। তলিয়ে যায় দুই হাজার পাঁচশ’ চিংড়ি ঘের। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি টাকা এবং ১৫ হেক্টর জমির কৃষি ফসল নষ্ট হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি বলে ক্ষতিগ্রস্তরা জানান।
প্রতিনিয়ত ঝড় বন্যা জলোচ্ছ্বাসের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকে উপকুলের মানুষ। প্রতিবছর কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে উপকূলে। ভেঙে যায় উপকূলের মানুষের স্বপ্ন। ২০২১ সালের ২৬ মে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের এক বছরে গৃহহীন হয়ে উপকূল ছেড়েছে কয়েকশ’ পরিবার। এদের মধ্যে কেউ খুলনা নগরীতে, কেউ রাজধানীতে আবার কেউ পার্বত্য অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়াতে যেতে বাধ্য হয়েছে। অনেকেই এখনও বাড়ি তৈরি করতে না ঝুঁপড়িতে বসবাস করছেন। পেশা পরিবর্তন ও পেশা হারিয়েছে বহু মানুষ। আর যারা এলাকায় রয়েছে তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে লড়াই করে।
খুলনা গেজেট/ টি আই