খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

মু‌হিত স্মরণে

ড. মুহাম্মদ ইউনুস

মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এটা রেডিওতে শুনে আমরা ন্যাশভিলের ছয়জন বাঙ্গালী তাৎক্ষণিকভাবে একত্র হয়ে বাংলাদেশ সিটিজেনস কমিটি গঠন করলাম। প্রত্যেকে এক হাজার ডলার জমা করে একটা তহবিল বানালাম। আমি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় উচ্চতম ব্যক্তি এনায়েত করিমকে ফোন করলাম। বল্লাম আমি ওয়াশিংটন রওনা হচ্ছি। সবার সঙ্গে আলাপ করে কর্মসূচি তৈরী করতে হবে। তিনি আমাকে উৎসাহ দিলেন চলে আসার জন্য। ছয় হাজার ডলারের তহবিল সঙ্গে নিয়ে পরদিন ওয়াশিংটনে গিয়ে সোজা উঠলাম এনায়েত করিমের বাসায় যার সঙ্গে কোনদিন আমার পরিচয় ছিল না।

এর পর ওয়াশিংটনে প্রায় রাতে মুহিত ভাইয়ের বাসায় সবাইকে নিয়ে বসা আমাদের নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়ালো। নানা সংবাদ আদানপ্রদান করা। নানা উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্ক। হাতাহাতি। সব কিছুই এই বৈঠকের অংশ হয়ে দাঁড়ালো। যারা ওয়াশিংটনের লোক তারা সারাদিন তাদের অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা ক’জন যারা অন্য শহর থেকে এসেছি তারা সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে কাজ করতে থাকলাম। একদিন মুহিত ভাই বল্লেন একটা ওয়্যারলেস সেটের জন্য কিছু টাকার দরকার। আমি ন্যাশভিলের ছয় হাজার ডলার তাঁর হাতে দিয়ে দিলাম।

আমরা ক’জন আরেকটা দায়িত্ব নিলাম । এটা হলো বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলিতে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাবার জন্য অনুরোধ জানানো। মুহিতভাই আমাদের সঙ্গে দূতাবাসগুলির পরিচয় করিয়ে দিতেন এবং আমাদের ব্রীফ দিতেন কার কাছে কীভাবে আমাদের প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে হবে।

দেশে ফিরে আসার পর আবার মুহিতভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হলো তাঁরই উদ্যোগে। তিনি আমার কর্মসূচি সম্বন্ধে জানতে চান। তিনি সরকারী চাকুরীতে বিরক্ত হয়ে গেছেন । বল্লেন তিনি আমার কর্মকান্ড চাক্ষুষ দেখতে চান। আমি সানন্দে ব্যবস্থা করলাম। তাঁকে নিয়ে পুরো একটা দিন টাংগাইলের হাঁটুভাংগা শাখায় কাটালাম। তাঁর হাজারো প্রশ্নের জবাব দিলাম। ঢাকা ফেরার পথে অনেক কথা বল্লেন। তিনি চাকুরী ছেড়ে দেবেন। আমার সঙ্গে গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করবেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা স্থাপন করবেন সিলেটে।

পরবর্তীতে শুনলাম তিনি সরকারী চাকুরী ছেড়ে দিয়েছেন। তারপর বোধ হয় বিদেশ চলে গেছেন। আবার দেখা হলো ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে। কুমিল্লা একাডেমীতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। আমরা দুজনেই সম্মেলনের বক্তা। আগের দিন সন্ধ্যায় অনেক আলাপ হলো। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এনিয়ে আমি একটা কনসেপ্ট পেপার লিখেছিলাম। সেটা তাঁকে দিলাম এবং মুখে সবিস্তারে বুঝালাম।

সম্মেলনের পরের দিন সকাল বেলায় আমাদের সবার ঢাকায় ফেরার কথা। কিন্তু হঠাৎ সারা দেশে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন জারী করেছেন।

আমরা কুমিল্লায় আটকে গেলাম। দুজনে আরো বহু কথা বলার সুযোগ পেলাম। কারফিউ প্রত্যাহারের পর সন্ধ্যায় ঢাকা ফিরলাম। পরদিন ঘোষণা শুনলাম মুহিতভাই নতুন সরকারে অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছেন। আমি অভিনন্দন জানালাম। তিনি দেখা করার জন্য খবর পাঠালেন। মনে মনে খুশী হলাম এই ভেবে যে এবার গ্রামীণ ব্যাংককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার সুযোগ পাবো।

দেখা করলাম। তারপর ঘটনা এগুতে থাকলো। এক পর্যায়ে এসে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ জারী হলো। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো নতুন ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। আমরা অনুষ্ঠানের জন্য এক পায়ে খাড়া। কিন্তু মন্ত্রণালয় চায় এটা ঢাকায় করতে। আমরা বেঁকে বসলাম। আমরা বললাম গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান গ্রামে হবে। মন্ত্রণালয় কিছুতেই এতে রাজী হবে না। আমি মুহিতভাইকে ফোন করলাম। তিনি সোৎসাহে বল্লেন – অবশ্যই এটা গ্রামে হবে। এবং আমি সেখানে যাবো।

১৯৮৩ সালের ৩রা অক্টোবর টাংগাইলের জামুর্কী গ্রামে ভূমিহীন মহিলাদের এক বিরাট সমাবেশের মাধ্যমে মুহিতভাইয়ের উপস্থিতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বহু আনন্দময়, স্বপ্নময়, গৌরবময় স্মৃতিগুলি স্মরণ করে মুহিতভাইকে আজ বিদায় জানাচ্ছি। আল্লাহ তাঁর রূহের মাগফেরাত দান করুন।

(‌ফেসবুক ওয়াল থে‌কে)




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!