খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ মাঘ, ১৪৩১ | ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  নাটোরে লালপুরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩ স্কুলশিক্ষার্থী নিহত
  নির্বাচনী অঙ্গনকে দুর্নীতিমুক্ত করতেই সংস্কারের প্রস্তাব : বদিউল আলম
  বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

মৃত্যুর আগে স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান জোহুরা বেগম

শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল সরদারের। পাক বাহিনীর হাতে অপহৃত কিশোরী কন্যা, গুলিবিদ্ধ সন্তান ও স্বামী হারানোর বেদনা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন বয়সের ভারে ক্লান্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল সরদারের স্ত্রী জোহুরা বেগম।

যুদ্ধকালীন নির্মম বিয়োগান্তক ঘটনার স্বাক্ষী জোহুরা বেগমের করুন আর্তি, জীবনের পড়ন্ত বেলায় স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চোখে দেখে যেতে চায়। কান্নাজড়িত কন্ঠে কথা হয় এ প্রতিবেদকের সাথে। যুদ্ধকালীন বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন বয়োবৃদ্ধা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পত্নী।

১৯৭১ সাল। চারিদিকে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিকামী মানুষের সাথে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের তুমুল লড়াই। গোটা দেশ যেন রণক্ষেত্র। সেদিন মুক্তিকামী অন্যদের সাথে বসে থাকতে পারেননি সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের মহন্দীর নিভৃত পল্লীর মৃত কাতার আলী সরদার ও গুলজান বিবির ছেলে আব্দুল সরদার। স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ট্রেনিং নিতে চলে যান ভারতে। সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানী সেনারা অন্যদের সাথে তাকেও ধরে নির্মম নির্যাতন শেষে নিয়ে যায় যশোর ক্যন্টনমেন্টে। সেখান থেকে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন শেষে অন্যদের পাশাপাশি তাকেও খুলনার গল্লামারী নিয়ে হত্যা করা হয়। তবে তখনও খবরটি পৌছায়নি তার প্রিয়তমা স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে।

এদিকে তার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা এমন খবরে স্বাধীনতা বিরোধীরা তাদের বাড়িতে হামলাসহ শুরু করে চরম নির্যাতন। অগ্নিসংযোগ করে তাদের বসত-বাড়িতে। এক পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে তার জোহুরা বেগম তার ২ ছেলে আজগর, রহমত ও ৪ মেয়ে আছিয়া, রশিদা, সুফিয়া ও সাহিদাকে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। আশ্রয় নেন শরনার্থী শিবিরে। সেখানে লোক মারফত শিবিরে থেকেই খবর পান তার স্বামী পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েছে। এরপর সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে সন্তানদের নিয়ে বেনাপোল বন্দর হয়ে সাতক্ষীরার উপর দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তারাও ধরা পড়ে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে।

এসময় পাকিস্তানী সেনারা তার কিশোরী মেয়ে সুফিয়াকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। মেজ ছেলে আজগর বোনকে বাঁচাতে ছুটে গেলে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে পাকিস্তানী সেনারা। এতে একটি গুলি তার হাত ও আরেকটি তার মাজার মাংসপেশী বিদীর্ণ করে চলে যায়। মূমুর্ষ অবস্থায় সকলে যখন তাকে নিয়ে ব্যাস্ত ততক্ষণে সুফিয়াকে নিয়ে হায়েনারা চলে যায়। এরপর থেকে সুফিয়াকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তো পাশবিক নির্যাতনে এক সময় সুফিয়াকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে।

এরপর দেশ স্বাধীনের বছর খানেক পর জোহুরা বেগম নিশ্চিত হন তার স্বামী ট্রেনিং থেকে দেশে ফেরার পথে ধরা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৫১ বছরেও তাদের খোঁজ রাখেনি কোন সরকার। খবর নেয়নি মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সংগঠনের কেউ।

আব্দুল সরদারের নাতনি লিলিমা খাতুন বলেন, শৈশব থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে তার নানা, খালা-মামাদের উপর ঘটে যাওয়া নির্মম কাহিনী শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি। গল্প শুনে যুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ণনা মুখস্ত হয়ে গেছে। তার দাবি মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথায় আঁচড় পড়ুক তার নানা ও খালার নাম দু’টি।

লিলিমা আরও বলেন, বীরঙ্গনা কাকে বলে ঠিক জানিনা। তবে যুদ্ধকালীন সর্বহারা নারীকে বীরঙ্গনার মুকুট দিলে তার খালা সুফিয়াও যুদ্ধজয়ে এক বুক কষ্ট ও রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নাম। তিনি বলেন, তার নানী (জোহুরা বেগম) নানার মৃত্যু খবর শোনার পর থেকে কারো সাথে খুব বেশী কথা বলেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে এখনো আৎকে ওঠেন। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে পথের ধারে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। আর চোখের পানি ফেলেন। হয়তো স্বামীর বীরত্বগাঁথায় নিজেকে গর্বিত অনুভব করে চোখের পানিতেই কষ্ট নিবারণ করেন তিনি।

জোহুরা বেগম বলেন, স্বাধীনতার অনেক বছর পর্যন্ত স্বামীর পথপানে চেয়ে দিন কাটতো তাঁর। বিশ্বাস ছিল, হয়তোবা তিনি এখনো বেঁচে রয়েছেন। ফিরে আসবেন স্ত্রী-সন্তানদের কাছে আপন ঠিকানায়। তবে বছরের পর বছর কেটে যাওয়ায় এখন নিজেকে কোন রকম বিশ্বাস করিয়েছেন বেঁচে নেই সে। বলতেই ফের চোখ ভিজিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠেন- তাদের স্বামীদের মৃত্যু হয়না, মরতে নেই ওদের।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!