দিনভর নাটকীয়তার পর জাতীয় পরিষদ পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট। অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে ডেপুটি স্পিকারের দেয়া সিদ্ধান্ত অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে বৃহস্পতিবার সন্ধায় এই রায় দেয়।
এর আগে গত ৮ই মার্চ ইমরান খানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয় পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো। এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা ও ভোটাভুটির জন্য অধিবেশন ডাকতে স্পিকারের প্রতি লিখিত আবেদন জানায় তারা। ইমরান খান তখনো আত্মবিশ্বাসী, তিনি বিরোধীদের উল্টো এক হাত দেখে নেয়ার কথা জানান। বলেন, অনাস্থা ভোটে বিরোধীরা হেরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত কিনা! পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের পর স্পিকারকে ১৪ দিনের মধ্যে অধিবেশন ডাকার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় রাজধানী ইসলামাবাদে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে দুইদিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকের জন্য সেই তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়।
এরপর ২৫শে মার্চ শুক্রবার আবারো অধিবেশন ডাকা হলেও সেদিন অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন ছাড়াই ২৮ তারিখ পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন স্পিকার। ২৮ তারিখের অধিবেশনে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ। সংবিধান অনুযায়ী প্রস্তাব উত্থাপনের পর তিন দিন পার হলেই ভোটাভুটি করা যায়। তবে ভোটাভুটির জন্য সাত দিনের বেশি সময় নেয়া যাবে না। ২৮ তারিখ প্রস্তাব উত্থাপনের পর আবারো ৩১শে মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি। এরপর সর্বশেষ এ নিয়ে ৩রা এপ্রিল ভোটাভুটির তারিখ নির্ধারিত হয়।
অনাস্থা প্রস্তাব আনার প্রথম থেকেই ইমরান খানকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল বিরোধীরা। তাদের পক্ষে ছিল ১৬২ আইনপ্রণেতাও। যদিও ইমরানকে সরাতে প্রয়োজন ছিল ১৭২ ভোটের। তবে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পর হঠাৎ করেই ইমরানের দল পিটিআই’র ২৪ এমপি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। তারা ইমরান খানের পক্ষত্যাগ করার ঘোষণা দেয়। এতে প্রচ- চাপে পড়ে যান ইমরান। বিরোধীদের আত্মবিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসে ইমরানের বিপদ তত বাড়তে থাকে। একদম শেষ মুহূর্তে সরকারি জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয় মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট। তারা তাদের ৫ আসন নিয়ে বিরোধীদের দলে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেয়। এর মধ্যদিয়ে ইমরান খানের অনাস্থা ভোটে হারা সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়।
তবে ক্রিকেট মাঠের মতো রাজনীতিতেও পাকা খেলোয়াড়ের মতো খেলে গেছেন ইমরান। তিনি আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন যে, শেষ বল পর্যন্ত ব্যাট করবেন তিনি। পাকিস্তানের পুরো রাজনৈতিক সংকটের জন্য তিনি বিদেশি শক্তিকে দায়ী করেন। প্রথমে কোনো দেশ ষড়যন্ত্র করছে না জানালেও পরে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আঙ্গুল তোলেন তিনি। প্রমাণ হিসেবে তিনি একটি চিঠি দেখান। সেই চিঠি তিনি সিনিয়র সাংবাদিক, মন্ত্রিসভা ও সেনাপ্রধানের কাছে তুলে ধরেন। এই ষড়যন্ত্রের দাবিকে ঘিরেই সর্বশেষ রাজনীতি চলতে থাকে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে। রাশিয়া সফরে যান ইমরান খান। সে সময় ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়াকে শাস্তি দিতে উন্মুখ হয়ে উঠেছে পশ্চিমা বিশ্ব। নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা চলছে। এরইমধ্যে ইমরানের মস্কো সফরকে ভালোভাবে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। সে সময়ই যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাক রাষ্ট্রদূতকে তলব করেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লু। তিনি অবিলম্বে ইমরান খানের সফর বাতিলের জন্য চাপ দেন। কিন্তু পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র। ৭ই মার্চ পাক রাষ্ট্রদূত আসাদ মজিদের সঙ্গে আবারো বৈঠক করেন লু। এতে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ইমরান খান যদি অনাস্থা প্রস্তাবে টিকে যান তাহলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে না।
একই ঘটনার কথা জানানো হয়েছে রাশিয়ার তরফ থেকেও। পাকিস্তানের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করছে দাবি করে এর নিন্দা জানায় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ইমরান খানকে শাস্তি দিতেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেই মার্কিন কূটনীতিক ডনাল্ড লুও। তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেননি। ইমরান খান তার নাম প্রকাশ্যে আনার পরবর্তী সময়ে ভারত সফর করেন তিনি। সেখানে হিন্দুস্তান টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাকে পাকিস্তান নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এ সময় ইন্টারভিউয়ার ডনাল্ড লুকে বলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন যে, আপনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাক রাষ্ট্রদূতের একটি আলোচনা হয়েছে। এতে আপনি তাকে বলেছেন, ইমরান খান যদি অনাস্থা ভোটে জয় পায় তাহলে পাকিস্তান ভয়াবহ বিপদে পড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ক্ষমা করবে না। বিষয়টি কি সত্যি? এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকেন লু।
তিনি বলেন, আমরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়টি নজরে রাখছি। আমরা দেশটির সাংবিধানিক প্রক্রিয়া এবং আইনের শাসনকে শ্রদ্ধা করি। ইন্টারভিউয়ার তাকে আবারো প্রশ্ন করেন যে, আসলেই এ ধরনের আলোচনা হয়েছিল কিনা। এর জবাবে মার্কিন এই কূটনীতিক বলেন, এই প্রশ্নের জবাবে তার আর কিছু বলার নেই।
এত সব নাটকীয়তার মধ্যে গত ৩রা এপ্রিল পার্লামেন্টে অধিবেশন শুরু হয়। হিসাব অনুযায়ী ওইদিনই অনাস্থা ভোটে হেরে বিদায় নেয়ার কথা ইমরান খানের। কিন্তু সেদিন পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হতে না হতেই শুরু হয় আরেক নাটকীয়তার। স্পিকার কাসিম সুরির সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবকে খারিজ করে দেন তিনি। এর পরপরই ইমরান খানের পরামর্শে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট। স্পিকারের এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবের স্বপ্ন ভেঙে যায় বিরোধীদের। এরপরই এই রাজনৈতিক সংকট সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়।
খুলনা গেজেট/ এস আই