লাভ-লোকসান না খুঁজে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে ও যাত্রীদের হয়রানি বন্ধে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিমানকে আর্থিকভাবে লাভজনক করতে অন্তত দুটি কার্গো বিমান কিনে পণ্য পরিবহন সেবা চালুরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
যাত্রাী সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি, কাস্টমস সিস্টেমকে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড করে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করার কথাও জানালেন প্রধানমন্ত্রী।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বুধবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বলাকা ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলো অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আরও বাড়ানো দরকার। মালদ্বীপে ইতিমধ্যে বেসরকারি খাত থেকে বিমান যাওয়া শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ বিমান…আমি মনে করি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে…, সবখানে লাভ-লোকসান খতিয়ে দেখার দরকার নেই। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা এবং কার্গো পরিবহন এটা একান্ত ভাবে দরকার।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে কার্গো বিমান দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমাদের বিমানে নিজস্ব কার্গো প্লেন থাকবে। কারণ পণ্য পরিবহন করলে বিমানই লাভবান হবে। কাজেই দুটো কার্গো বিমান ক্রয় করা একান্তভাবে জরুরি বলে আমি মনে করি। প্যানডেমিকের জন্য অনেক টাকা-পয়সা আমাদের খরচ করতে হয়েছে এবং আমরা বিনে পয়সায় ভ্যাকসিন দিচ্ছি, বিনে পয়সায় টেস্ট করা হচ্ছে।
‘তারপরও আমি বলব যে, এখন থেকে উদ্যোগ নিলে পরে যথাযথভাবে এটা ক্রয় করা সম্ভব। কার্গো সার্ভিস চালু থাকলে বিমান আরও লাভজনক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি চাই আমাদের কার্গো হ্যান্ডলিং, বিমান হ্যান্ডেলিং আন্তর্জাতিক মানের হোক।’
বন্ধ করতে হবে যাত্রী হয়রানি
বিমানের সেবা নিতে যাত্রীরা যাতে কোনো ধরনের কষ্ট না পায় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে বলে জানিয়েছেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাস্টমস সিস্টেমটাও সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড করে ফেলতে হবে। মানুষ যখন বিদেশ থেকে আসে তখন হয়তো কিছু পণ্য ক্রয় করে নিয়ে আসতে চায়। তারা যেন কোনো হয়রানির মধ্যে না পড়ে। পুরোটা ডিজিটালাইজড হয়ে যায়, সহজেই যাত্রী সেবা দেয়া সম্ভব হবে। সে বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে।’
প্রবাসীদের প্রতি আরও আন্তরিক হওয়ার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের প্রবাসীরা আমাদের দেশের জন্য কাজ করে। প্রায় এক কোটির মত লোক আছে। ছুটির সময় তারা দেশে আসে। সেই কথাটা বিবেচনা করে, তারা যেন কোনোরকম হয়রানির শিকার না হয়, সেটার জন্য আমাদের আরও যত্নবান হতে হবে।’
দেশের সবকটি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরকে আরও উন্নত করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘দেশে একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল আমরা গড়ে তুলছি। সেখানে বিনিয়োগের জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। সেখানে শিল্পায়ন হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থা যত সুন্দর হয়, দ্রুত হয় বিনিয়োগকারীরা এখানে আসবেন, বিনিয়োগ করবেন।
‘আমাদের দেশের জনগণ বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেন, তাদেরও যোগাযোগটা ভালো হলে কর্মক্ষেত্রের দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। তা ছাড়া বিনোদন ক্ষেত্রটাও আরও সুগম হবে। সেদিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে বর্তমানে চারটি বৃহৎ পরিসরের বোয়িং ৭৭৭-৩০০-ইআর, চতুর্থ প্রজন্মের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত চারটি ৭৮৭-৮ ও দুটি ৭৮৭-৯ সহ মোট ছয়টি ড্রিমলাইনার, ছয়টি ৭৩৭-৮০০ এবং পাঁচটি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ আমরা সংগ্রহ করি। এখন ২১টি উড়োজাহাজ নিয়ে বিমান চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যে নতুন উড়োজাহাজগুলো কিনেছি, সেগুলো যেন যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যেন থাকে, সুন্দরভাবে যেন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, সেটা সবার কাছে আমার অনুরোধ।’
নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও জনবল দিয়ে অত্যাধুনিক বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ার রিপ্লেসমেন্ট এবং বোয়িং ৭৮৭ এর সি-চেক কার্যক্রম দেশে শুরু হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘কাজেই এই টেকনোলজি শেখা, এটাকে নিয়ে আসা, এটাকে কার্যকর করার দিকে আমাদের আরও বেশি করে মনোযোগ দিতে হবে। যাতে আমাদের অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে না হয়। তাতে আমাদের দেশের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়।’
গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ে নতুন ইউনিট
গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের ক্ষেত্রেও বিমান অনেক উন্নতি করেছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দক্ষ এবং কার্যকর গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করার জন্য একটা ইউনিট আমরা করতে চাই। আমি বিমানকে বলব, এটার জন্য কিছু প্রশিক্ষণও দরকার আছে, লোকবলের দরকার আছে।’
সততা ও দক্ষতার সঙ্গে যেন গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করা যায় সেদিকে বিশেষ নজর দেয়ার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইউনিটটা যত দ্রুত পারা যায়, তৈরি করা দরকার। যাতে উপযুক্ত লোকবল আমরা সেখানে দিতে পারি। যাতে যাত্রী সেবাটা আরও উন্নতমানের হয়, আমরা সেটাই করতে চাই।’
নিজেদের বহরে চতুর্থ প্রজন্মের বিমান সংযুক্ত হওয়ায় যাত্রীদেরকে আকাশে ওয়াইফাই সুবিধাসহ বিভিন্ন প্রকার ইনফ্লাইট বিনোদন সেবা প্রদান করা হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের অনেক দেশের বিমান থেকে বাংলাদেশ বিমানের খাবার মান ভালো বলেও দাবি করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা প্রবাসী বাঙালি তারা বিমানে চড়তেই পছন্দ করেন। বিমানের প্রতি তাদের আগ্রহ রয়েছে। সেটা মাথায় রেখে আমাদের আরও বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে হবে। যাত্রীদের সেবাগুলো যেন আরো সুন্দর হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
মার্চ থেকে ডিজিটাল যাত্রী সেবা
মার্চ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেমটিকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা হচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘অনলাইন টিকেটিং, রিজারভেশন, বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পূর্বে চেক-ইন সবকিছু অনলাইনে হবে। এটা আমাদের প্রবাসীদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক হবে, এজন্য যে টিকেট কিনতে গেলে সিট খালি থাকলেও দেখা যায়, বলে দেয় সিট নেই। অথবা নানা ধরনের সমস্যায় ভুগতে হয়।
‘তাছাড়া এখন সবাই ব্যস্ত থাকে, কাজ করেন। কিন্তু অনলাইনে যখন টিকিট কেনা বা সিট বুকিং করা বা অনলাইন চেকিং…পৃথিবীর সব দেশে এ ব্যবস্থাটা আছে। আমরা এক্ষেত্রে একটু পিছিয়ে ছিলাম। আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি বিমান সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
শাহজালালে বসবে রাডার
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এর কাজ করোনা কালেও বন্ধ হয়নি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘টার্মিনালটা হয়ে গেলে আমাদের বিমানের দক্ষতা আরও বাড়বে। তা ছাড়া নতুন রাডার স্থাপন করা হবে। একেবারে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন রাডার আমরা স্থাপন করব, সেই ব্যবস্থাও আমরা নিয়েছি।’
রাডারে সুবিধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের না, আমাদের আকাশসীমা দিয়ে অন্য যত দেশের যত বিমান যাক, সবার জন্যই এটা সুবিধাজনক হবে, লাভজনক হবে। সেটা আমরা করে দিচ্ছি।’
করোনা মহামারির মধ্যে চীনে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধার, প্রবাসীদের নিয়ে আসা, শান্তিরক্ষী মিশনে শান্তিরক্ষীদের পৌঁছে দেয়ায় বিমানকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘করোনার মহামারিতে বিমানকে প্রণোদনা হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকা দিয়েছিলাম। তাদের যেখানে যত ঋণ আছে তা যেন সহজে মেটাতে পারে। সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছিলাম। সেটা যথাযথভাবে ব্যবহার হয়েছে।’
ডাকটিকিট ও খাম উন্মোচন
এর আগে গণভবনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত ও উদ্বোধনী খাম উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মারক ডাকটিকেটের মূল্য ১০ টাকা।
গণভবনে সকালে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা স্মারকও গ্রহণ করেন সরকারপ্রধান।
এসময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও সচিব মোকাম্মেল হোসেন, বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল উপস্থিত ছিলেন।