‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো-তোমার মনের মন্দিরে’- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এই গান যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে কেশবপুরের নিভৃতপল্লী মেহেরপুরে বাঙালি নারী রহিমা ও মার্কিন প্রকৌশলী ক্রিস্টফার মার্ক হোগলের জীবনে। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে তাঁরা একে-অপরকে গোলাপ ফুল বিনিময় করাসহ কেক কাটেন।
রহিমা খাতুন কেশবপুরের মেহেরপুর গ্রামের মেয়ে। তাঁর প্রেমে পড়ে আমেরিকার প্রেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্টফার মার্ক হোগল এখন কেশবপুরের অজপাড়াগা মেহেরপুর গ্রামে এসে বসবাস করছেন।
রহিমাকে বিয়ে করে আর ফিরে যাননি তিনি আমেরিকায়। ক্রিস্টফার মার্ক হোগল এখন আয়ুব হোসেন নামে পরিচিত। তাঁরা একে-অপরকে ভালোবাসার বন্ধনে বাকি জীবন মধুকবির স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ তীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে গড়ে ওঠা মেহেরপুর গ্রামেই থাকার জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি গড়ে তুলেছেন। ক্রিস্টফার মার্ক হোগলের সুন্দর ব্যবহারে এলাকার মানুষও মুগ্ধ। রহিমা ও হোগলের মধ্যে অটুট ভালোবাসা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
সরেজমিনে মেহেরপুর গ্রামে রহিমা ও ক্রিস্টফার মার্ক হোগলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বিদেশি শেতাঙ্গ হোগলের শরীরে ট্যাটু আঁকা। একটু এগিয়ে এসে ক্রিস্টফার মার্ক হোগল ওরফে আয়ুব হোসেন আমাদের আধো উচ্চারণে সালাম দিলেন। ওই সময় রহিমা বাড়িতে ছিল না। কিছু সময় পর রহিমার পুত্র বধূ এসে হাজির, তাকে রহিমা কোথায় গেছে জানতে চাইলে বলেন ধান মাড়াই করতে। কথা চলাকালেই রহিমা ভ্যান ভর্তি মাড়াই করা চাল নিয়ে হাজির। হোগল এগিয়ে গিয়ে ভ্যানটি ঠেলে এগিয়ে নিয়ে আসে এবং ভ্যানের উপর থেকে মাড়াই করা চালের বস্তা নিজেই কাধে করে নিয়ে ঘরে উঠালেন।
কাজের ফাঁকে ফাকে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানায়, তার বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। পেশায় তিনি পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার। রহিমা খাতুনের সঙ্গে ভারতের আসানসোলে তাঁদের প্রথম পরিচয় হয়। পরিচয়েই তাঁরা একে-অপরকে ভালোবেসে ফেলেন। ভালোবাসার একপর্যায়ে ছয় মাস পর তারা ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ক্রিস্টফার মার্ক হোগল নিজেকে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন পুরোপুরি। তিনি নিজ হাতে কৃষি কাজের পাশাপাশি গরু-ছাগল পালন করছেন। গরু ও ছাগলের খাবারও নিজ হাতে তৈরি করেন পরম মমতা নিয়ে।
রহিমা খাতুন বলেন, তিনি ছোটবেলায় বাবা-মায়ের হাত ধরে ভারতে যান। সেখানে তাঁরা কাজ করতেন। তাঁর বয়স যখন প্রায় চৌদ্দ বছর তখন তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর তিন সন্তান হলে তার ওই স্বামী তাদেরকে রেখে অন্যত্র চলে যায়। তখন তিনি জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই শহরে গেলে ক্রিস্টফার মার্ক হোগলের সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাকে নিয়ে হোগল চীনে যান। সেখানে ৫ বছর থাকার পরে হোগলকে নিয়ে নিজের জন্মভূমিতে প্রায় ৪ বছর ফিরে এসে বসবাস করছেন। রহিমা খাতুন স্বামী হোগলের সঙ্গে থাকতে থাকতে ইংরেজি, হিন্দি ও চায়না ভাষা রপ্ত করেছেন। রহিমা মেহেরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল খাঁ ও নিছারুন বেগমের মেয়ে।
হোগলের আমেরিকায় এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। আমেরিকার স্ত্রী সঙ্গে তার অনেক আগেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। আমেরিকার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে।
রহিমার বড় ছেলের স্ত্রী তামান্না খাতুন বলেন, শ্বশুর ক্রিস্টফার মার্ক হোগল (আয়ুব হোসেন) তাদেরকে খুবই ভালোবাসেন। তার ব্যবহার অত্যন্ত ভালো। এলাকার মানুষের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করে মন জয় করেছেন। তিনি কৃষি কাজসহ গরু-ছাগল পালন করছেন। বাড়িতে ৭টি গরু ও ৯টি ছাগল নিজ হাতে দেখাশোনা করেন। তিনি এবার ১৫ কাটা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন।
রহিমা খাতুন আরও বলেন, তাঁরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই এক-অপরকে ভালোবেসে থাকতে চান। তিনি আমেরিকার দুই সন্তানকেও মেহেরপুরের বাড়িতে আনবেন। হোগল মহাকবি মাইকেল মধুসুদন সম্পর্কে জানেন। তার কবিতা পড়েছেন। সাগরদাঁড়ি বেড়াতে গেছেন।
রহিমার বাবার বাড়ি মেহেরপুর গ্রামের মুন্সি মেহেরুল্লার মাজারের পাশে অবস্থিত। হোগল মাজার খুব পছন্দ করেন। ওই মাজার ঘুরে দেখার সময় তিনি এর পবিত্রতা রক্ষাসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান করেন।
তিনি আধো আধো বাংলায় বলেন, আমি রহিমাকে খুব ভালোবাসি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে রহিমাকে নিয়ে কপোতাক্ষ নদ তীরে ঘুরে বেড়াবেন।
মুন্সি মেহেরুল্লাহ মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বলেন, রহিমা ও হোগলের ভালোবাসার কাহিনী এলাকায় সিনেমার ভালোবাসার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। তাছাড়া হোগল এলাকার মানুষকে খুবই ভালোবাসেন। বিশেষ করে শিশুরা তার বাড়িতে এলে খুবই স্নেহ করেন।
খুলনা গেজেট/ এস আই