গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে কিছুদিন একটি তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করেছেন খুলনার মেয়ে আসমা আকতার ববি। করোনা সংক্রমণ এবং নিজ উদ্যোগে কিছু করার তাগিদে গত মার্চ মাসে চাকরি ছেড়ে দেন। শুরু করেন অনলাইনে নারীদের প্রসাধনীসহ নিত্য ব্যবহারিক পণ্য বিক্রি। গত ৬ মাসের ব্যবধানে তার ‘ববি বিউটিফিকেশন’ ব্যবসায়িক পেজে নিয়মিত ক্রেতার সংখ্যা শতাধিক।
খুলনা গেজেটকে ববি বলেন, এতো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে অন্যের অধীনে চাকরি করতে ভালো লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকে আমার ইচ্ছা ছিলো নিজের একটা ব্যবসা হবে। শুরুর দিকে কিছুটা ভয়ে ছিলাম, কিন্তু গত ৬ মাসে আস্থা তৈরি হয়েছে, মনে হচ্ছে আমি পারবো।
খুলনার আযমখান সরকারি কমার্স কলেজের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং থেকে মাস্টার্স করেছেন আয়শা আবদুল্লাহ প্রিয়াংকা। গত এপ্রিল মাস থেকে অনলাইনে তৈরি খাবার সরবরাহ শুরু করেন। তাকে সহযোগিতা করছেন তারই স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন মানিক। অল্পতেই খুলনায় পরিচিতি পায় তার ব্যবসার পেজ ‘ফুডিস ফেস্ট’।
আয়শা আবদুল্লাহ জানান, কলেজ থেকে শখ ছিলো নতুন নতুন রেস্টুরেন্টে খাওয়া। ওই সময় একটি রেস্টুরেন্ট খোলার শখ ছিলো। করোনায় ঘরে বসেই অনলাইনে বিক্রি শুরু হলে খুব ভালো সাড়া পাই। এতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
শুধু আসমা আকতার ববি বা আয়শা আবদুল্লাহ প্রিয়াংকাই নন; অনলাইন ব্যবসায় ঝুঁকেছেন খুলনার অনেক তরুণ-তরুণী। তাদের একটি বড় অংশ উচ্চ শিক্ষা শেষ করে চাকরি না করে ব্যবসা করছেন। এদের বাইরে অনেক গৃহিনী এবং শিক্ষার্থীও ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। অনলাইন ব্যবসার বেশিরভাগ নেতৃত্বে রয়েছেন নারীরা। নিজের স্বামী ও ভায়েরা তাদের সহযোগী।
তাদের ব্যবসা পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পোশাক, দেশী তৈরি পোশাক, দেশী-বিদেশী ব্রান্ডের প্রসাধনী, বিদেশ থেকে আমদানি করা মেয়েদের ব্যাগ-জুতাসহ ফ্যাশানেবল পণ্য, বিরানি, তেহেরীসহ ঘরে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার ও কেক। করোনার পর এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাজারসহ নিরাপত্তা উপকরণ।
খুলনায় অনলাইনে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ঠিক কতো তার পরিসংখ্যান কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পণ্যের বিজ্ঞাপন এবং অনলাইনে পণ্য বিক্রির বিভিন্ন অ্যাপ থেকে এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, গত একবছরে নারীদের একটি বড় অংশ অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। তরুণ উদ্যোক্তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে কেনাকাটার প্রসারও বাড়ছে। তবে ব্যবসায় বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে করোনা সংক্রমণ। যার প্রভাব পড়েছে প্রতিটি ব্যবসার ক্ষেত্রেই।
‘ববি বিউটিফিকেশন’ এর আসমা আকতার ববি বলেন, করোনার কারণে পণ্য আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বিক্রিতে। আয়শা আবদুল্লাহ প্রিয়াংকা জানান, গত এক মাসে হঠাৎ করে বিক্রি কমে গেছে। তিনি বলেন, গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রতিদিন ২০০ জনের কাছ থেকে অর্ডার পেতাম। যেটা এখন ৩০ থেকে ৫০ এ নেমে এসেছে।
খুলনায় বসে গত ৫ বছর ধরে অনলাইনে তৈরি পোশাকের ব্যবসা করছেন অ্যাবসলিউট ক্রিয়েশনস বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠান। এর সত্ত্বাধিকারী তানজিলা আমজাদ খুলনা গেজেটকে বলেন, ৫ বছর আগে অনলাইনে কেনাকাটায় মানুষ ততোটা অভ্যস্ত ছিলো না। বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরুটা চ্যালেঞ্জিং ছিলো। তবে দেশের মানুষ এখন অনলাইন শপিং এ অভ্যস্ত হয়ে পরিস্থিতি পাল্টেছে। করোনাকালীন পরপর দুটি ঈদেই আমরা ভালো ব্যবসা করেছি। দিন দিন অনলাইনে ব্যবসার প্রসার বাড়ছে। মানুষ এখন ঘরে বসেই কম সময়ে ও সহজে লেটেস্ট ফ্যাশানের ভালো কোয়ালিটির পণ্য হাতে পাচ্ছে। অনেকেই এই ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। এতে করে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে ব্যবসায় বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিদেশে যাতায়াত বন্ধ থাকায় এখন পণ্য আমদানি করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিয়ে, উৎসব ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকেই নতুন ড্রেস কিনছে না। আবার মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেকেই এখন অনলাইনে ড্রেস কিনছে না। করোনা পরিস্থিতির ধকল সামলিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লেগে যাবে বলে মনে হচ্ছে।
তবে ব্যবসা মন্দা হলেও নতুন নতুন উদ্যেক্তা তৈরি হচ্ছে প্রতিদিনই। লন্ডনে বিবিএ সম্পন্ন করে গত কয়েকবছর বাড়িতে বসেই সময় কাটাচ্ছেন সালমা আকতার হ্যাপি। চলতি বছরের শুরু থেকে তৈরি পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তার পেজের নাম ‘আলিজান ক্লথিং’।
সালমা আকতার হ্যাপি খুলনা গেজেটকে বলেন, করোনাসহ নানা কারণে দেশে অনলাইনে কেনাকাটার পরিধি বেড়েছে। আর কেনাকাটার ক্ষেত্রে সবাই মান সম্পন্ন পোশাক চায়। এই নিশ্চয়তা দিতে পারলে ব্যবসার প্রসার বাড়তে সময় লাগে না। তিনি বলেন, নিজের কিছু করতে হবে-এমন তাগিদেই ব্যবসা শুরু করা। আর নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারলে ঘরে-বাইরে সব জায়গাতে অনেক বেশি সম্মান পাওয়া যায়। যেটা এখন পাচ্ছি।
খুলনার কমার্স কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স করে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নেমেছিলেন মশিউর রহমান সুমন। করোনার কারণে মার্চ থেকে ব্যবসা বন্ধ। আয় বন্ধ হওয়ায় বিকল্প হিসেবে বিদেশ থেকে করোনা নিরাপত্তা সামগ্রী আমদানি শুরু করেন। তার আমদানি করা মাস্ক, গ্লাভস, পালস অক্সিমিটার, প্রেশার মিটার এখন খুলনার বিভিন্ন খুচরা দোকানে বিক্রি হচ্ছে। খুলনা গেজেটকে তিনি বলেন, ব্যবসার ধরণ বুঝতে পারলে অনলাইনে ভালো ব্যবসা করা যায়। যার কারণে আপদকালীন সময়ে সবাই সেই দিকেই ঝুঁকেছে।
খুলনা গেজেট / এমএম