রাজধানীর শ্যামপুরের জুরাইনে আদ-দ্বীন হাসপাতালের পাশে একটি মার্কেটের জুতার কারখানা ও শোরুমে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাতটি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
সোমবার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। রাত সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার দেওয়ান আজাদ।
তিনি বলেন, রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে আমরা রাজধানীর শ্যামপুরের জুরাইনে আদ-দ্বীন হাসপাতালের পাশে জুতা তৈরির একটি কারখানায় আগুন লাগার খবর পাই। প্রথমে ছয়টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। পরে আরও একটি ইউনিট সেখানে পাঠানো হয়। সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এছাড়া আগুনে কারো হতাহতের খবর এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বিস্তারিত জানা যাবে বলেও জানান ডিউটি অফিসার দেওয়ান আজাদ।
গণতন্ত্রের জন্য দেশে যুদ্ধ করেছি
আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঝিনাইদহ
সত্তর সালে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের দেশে ছাত্র জনতা আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। সেই আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (মাওলানা ভাষানি), শেখ মুজিবুর রহমান সহ আরো অনেকে। তখন আয়ুব খান নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সেই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় যুক্ত হয় আমাদের শেখ মুজিবর রহমান। শেখ মুজিব জয়যুক্ত হবার পরও পাকিস্তানি সরকার আয়ুব খান তার হাতে ক্ষমতা না দিয়ে, দেশের মানুষের উপর অত্যাচার শুরু করে। এরপর আমাদের দেশের ছাত্র-জনতা সাথে নিয়ে শেখ মুজিব আন্দোলনমুখী হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় মিটিং করে বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে উৎসাহ দেয়। ৭ই মার্চের ভাষণ দেন। বক্তব্যে বলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তাদেরকে ভাতে মারবো, পানিতে মারবো এমনভাবে বক্তব্য দিয়ে জনগণকে উৎসাহ দিতে থাকে। তারপর থেকে সারাদেশে আন্দোলন সংগ্রাম মিছিল মিটিং শুরু হয়ে যায়। সেই আন্দোলন হয়, প্রতিরোধ আন্দোলন, অধিকার আদায়ের। তখন পাকিস্তানি বাহীন দেশের নিরীহ মানুষের উপর হামলা শুরু করে। তারপর থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত কথা বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ গোলাম ছারোয়ার।
ঝিনাইদহ সরদ উপজেললার ১নং সাধুহাটি ইউনিয়নের মাগুরাপাড়া গ্রামের মৃত কুবাদ আলীর ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম সারোয়ার। তিনি ১৯৫৬ সালে কুষ্টিায় জেলার কন্দোর্পদিয়া গ্রামে। তিনি পড়াশুনা করেছেন ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু ভায়না মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। যুদ্ধ কালীন সময় তিনি নবম শ্রেণীতে পড়তেন। যুদ্ধ শুরুর হবার পরপরই চলে আসেন সদর উপজেলার সাধুহাটি এলাকায়। যুদ্ধ শেষে তিনি বাড়িতে ফিরে এসে ১৯৮৩ সালে ওই ওয়ার্ডে মেম্বর প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। পরপর তিনবার-এরপর আবারো দুইবার তিনি ইউপি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের সাথে মুক্তিযুদ্ধের লোমহর্ষক কাহিনী তুলে ধরেন।,
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম সারোয়ার বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের জ্বালাময়ী ভাষণটা দেন, তখন রেডিওতে ভাষণ শুনতাম। বন্ধুরা মিলে খুব উৎসাহ পেতাম তার বক্তৃতা শুনে। এই আন্দোলন সংগ্রাম চলতে চলতে হঠাৎ ২৫ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে গেলেন। গ্রেফতার হবার পরপরই ছাত্র-জনতা, পুলিশ, ইপিআর সহ সাহসী জনগণ প্রতিরোধ যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের দেশের নওজোয়ানরা, আনসার ই-পিআর, পুলিশ তখন উসমানী নেতৃত্বে তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ করতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, বন্ধুদের সাথে সবাই উল্কার বেগে প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনের দিকে ছুটে যায়। তখন আমদের অস্ত্র ছিল লাঠি, বল্লম, ফালা এবং চুরি। আমরা যেতে যেতেই দেখতে পায় পাকিন্তানিরা হেরে গিয়েছে তাদের লাশ পড়ে আছে। সেখান থেকে কিছু সৈনিক দিকবিদিক পালিয়ে যায়। এবং সেখান থেকে তারা ঝিনাইদহ হয়ে যশোরের দিকে যাচ্ছে। যাবার সময় তারা সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই হত্যা করছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পথিমধ্যে সদর উপজেলার বিষয়খালি বাজারে প্ররিতোধ যুদ্ধের সম্মুখিন হয়। সেখানে ইপিআর, আনসারসহ বেশকিছু সাধারণ মানুষ শহিদ হয়। তবে আমরা পালিয়ে যাওয়া সৈনিকদের গ্রামে গ্রামে খুঁজে খুঁজে তাদেরকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারি। এটাই ছিলো যুদ্ধের শুরু।
তিনি আরো বলেন, ২৯শে মার্চে কুষ্টিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধ করে যখন বাড়ি ফিরে পরের দিন স্কুলে যায়, তখন আমরা বন্ধুরা শুনতে পাই। আমাদের হরিনাকুন্ডুর ভবানীপুর গ্রামে বিহারী, রাজাকারদের সহযোগীতায় এলাকার পরিচিত লোক (ডাকাত দল) লুট করতে এসেছে। এরপর আমরা বন্ধুরা মিলে ভবানীপুর গ্রামে পৌঁছে জায়। তারা ডাকাতি করতে (ট্রাক) গাড়ি নিয়ে এসেছিল। আমরা সেই গাড়ির টায়ার বাস্ট করে দিই। যাতে পালাতে না পারে। এরপর গ্রামবাসিকে সাথে নিয়ে তাদেরকে দৌড়ায়ে দৌড়ায়ে ধরি। তাদের মধ্যে বাঙালি খারাপ ছেলেরাও ছিল। বিহারী এবং রাজাকাররা ছিল। সেখান থেকে তাদেরকে বেধরক মারপিট করে আটকে রাখি। মানুষের উপকার করার জন্যই মূলত আমরা সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম।
তাদের উদ্ধার করেত পাকিস্তানি সৈনিকরা আসার আতঙ্কে রাতে আমাদের গুরুজনরা তাদেরকে ছেড়ে দেয়। ওই ঘটনার দুই দিন পর বাড়িতে বসে সবার সাথে ভাত খাচ্ছি এমন সময় আমার বড় ভাবি বললো, গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানি আর্মি ঢুকছে। যাকে পাচ্ছে মেরে ফেলছে। সবাই গ্রাম থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। এই শুনে আমি আর আমার একবন্ধু মিলে পাশের গ্রামের দিকে যায় পাকিস্তানি আর্মি দেখতে। তখন আমাদের সামনে ভবনীপুর গ্রামের দুইজন কৃষক নাঙ্গল কাধে করে মাঠে যাচ্ছিল তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে এবং সামনে যা পাই তাই পুড়িয়ে দিতে থাকে। এই দেখে আমরা দৌড়ে বাড়িতে চলে আসি। এরপর আমরা ভবতে থাকি এদের প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের অস্ত্র দরকার। অন্ত্রের সন্ধান করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি ভারত আমাদের অস্ত্র দিচ্ছে, প্রশিক্ষন দিচ্ছে, আমাদেরকে সহয্য করছে। তখন আমাদের দেশ থেকে বিশাল এক স্মরনার্থীরা ভারতে যাচ্ছিল। আমরা তখন বাড়িতে না গিয়ে স্মরণার্থীদের সাথে যোগদিয়। মূলত ২৫ মার্চে শেখ মুজিবকে আটকের পরে, আমাদের দেশে যে পাকিস্তানী আর্মি ছিল তারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা সহ বিভিন্ন শহরে ঢুকে মানুষের অত্যাচার শুরু করলে মানুষ ভারতে পালাতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধে কেন গেলেন?
আমি তখন ছাত্র ছিলাম। ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার ভায়না বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ি। পাকিস্তানি আর্মি এবং পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের দেশটাকে জিম্মি করে রেখেছিল। আমাদের বাকস্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে রেখেছিল। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু,মাওলানা ভাসানী এবং আরো অনেক নেতারা গণতন্ত্র রক্ষার্থে স্বাধীনতা রক্ষার-তে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে তাদের সাথে বিদ্রোহ করে। তখন তারা নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। নির্বাচন হওয়ার পর বাংলাদেশে তথা পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে তখন ক্ষমতা দেয়নি। তখন বঙ্গবন্ধু সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা আন্দোলন সংগ্রামের ডাক দেয়। এরিমধ্যে পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের পুরো বাংলাদেশটাকে তারা দখলে নিয়ে নেয়। বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়ি, থানা, সেনাবাহিনী ক্যাম্প পাকিস্তানী সেনাবাহিনীরা দখলে নেয়।
তবে আমরা শেখ মুজিবকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা তাকে সেই ক্ষমতা দেয়নি। তাকে ক্ষমতা না দিয় উল্টো ২৫ শে মার্চে আটক করে পাকিন্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকেই বাংলাদেশ প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। পঁচিশে রাত পর্যন্ত মানুষ কোন ধরনের প্রতিরোধ কিংবা যুদ্ধে যায়নি, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পরপরই মানুষ প্রতিরোধযুদ্ধ, এরপরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বাঙালি গণতন্ত্রের ভোটে জয়লাভ করার পরও আমাদের হাতে ক্ষমতা না দেওয়ার কারণে আমাদের যুদ্ধ করে গণতন্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বা স্বাধীনতা যুদ্ধে গেছি।
কিভাবে ভারতে পৌছালেন? মুক্তি বাহিনীত যোগদান করলেন কিভাবে?
স্মরনার্থীরা গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি ঘোড়ার গাড়িসহ পায়ে হেঁটে যেতে থাকে। আমরাও তাদের সাথে যায়। তাদের সাথে ছিল খাবার, কাপড়ের পুটলা এবং জিনিসপত্র। তাদের দু-একজন লোকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। পথ ধরে যেতে যেতে অনেক দূর পথমধ্যে তারা অবস্থান করে রান্নাবান্না করে, তারাও খায় আমাদেরকেউ খেতে দেয়। আমি কখনোই হিন্দু বাড়িতে খায়নি তারপরও তখন খুদা নিবারনের জন্য খেয়েছিলাম।
আমরা ভারতের বর্ডার পার হয়ে শিকারপুর এলাকায় পৌঁছাই। সেখানে এক দোকানে বসে মাটির কাপে চা খাচ্ছিলাম। মাটির কাপে চা এবং মুড়ি দিয়েছিল। সেটা আমার জীবনের প্রথম। ওই চায়ের দোকানের পাশেই ছিল শিকারপুর আর্মি ক্যাম্প। তখন আমার বন্ধুকে ক্যাম্পে যাওয়ার কথা বলি। আমি ওকে বলি হিন্দুদের খাবার তো খাওয়া যায়না চল আমরা সেনাবাহিনী ক্যাম্পে চলে যাই। ওখানে গেলে অস্ত্রও পেতে পারি। তারপর আমরা ক্যাম্পে চলে যাই। ওখানকার সেনারা খুবই আন্তরিক ছিল। আমরা ওখানে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদেরকে খুব আদর আপ্যায়ন করে। আমাদেরকে কাপড় চোপড় দিয়ে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করে নিতে বলে। তারা আমাদেরকে চেনে না কিন্তু আমাদের খুব আদর যতœ করে। তারা আমাদের দেশের সবকথা শুনে। এরপর সেখান থেকে একজন আর্মি অফিসার তাদেরকে অর্ডার করলো ওই দু’জনকে জুতা কাপড়-চোপড়সহ যা যা লাগবে দিয়ে দাও। তখন আমাদের নাম ঠিকানা লিখে নেই এবং আমাদের একটা নাম্বার দেয়। ওই প্রথম শিকারপুর ক্যাম্পে আমি মুক্তিযুদ্ধে জন্য অংশগ্রহণ করলাম।
কিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলন? কার অধিনে?
শিকারপুর ক্যাম্পে আমাদের দুই-তিন দিন ধরে পিটি প্যারেড করালো। এরপরে আমাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে লাগলো। আমাদের প্রথমে থ্রী নট থ্রী রাইফেল দিয়ে বলে এগুলো খোলো এবং লাগাও। এভাবে দুই-তিন যেতে লাগলো। যুদ্ধের জন্য প্রাথমিক ভাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি সেই সময় দুপুরে খাওয়া দাওয়া করার জন্য পুকুরে গোসল করতে যায়। সেই সময় হঠাৎ ক্যাপ্টেন হাফিস সাহেব গিয়ে হুইসেল দিতে থাকে। তখন সবাই দ্রুত ভেজা কাপড় পরেই তার সামনে লাইনে দাড়িয়ে গেলাম। এরপর ওই লাইন থেকে এক এক করে বাছাই করতে লাগলো। সেখানে বাছাইপর্বে ৩০ থেকে ৩৫ জনকে বাছাই করে। বাছাইয়ের পর বলে দৌড়ে গিয়ে গোলপোস্টের রড ছুয়ে আবার তাদের কাছে আসতে হবে। আমরা দৌড়ে গিয়ে সেই পিলার ছুয়ে আবার চলে আসি। তখন আমাদেরকে বলে যার যে জিনিস আছে সবাই গুছায়ে নাও গাড়িতে ওঠো। আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমরা কিছু জানি না। শুধু জানি আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছি, তৈরি হচ্ছি। ওখান থেকে আমাদের বনগাঁও ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখি বিশাল এক সেনা বাহিনীর ক্যাম্প তখন আমরা জানতে পারলাম আমরা বনগাঁও সেনাবাহিনী ক্যাম্প এসেছি। সেখানেও আমাদের নাম-ঠিকানা লিখল এবং আমাদের নিজেদের একটা ক্রমিক নাম্বার দিল। আমার ক্রমিক নম্বর ছিল ৫০৭৭। যা আমার বন্দুকেও লেখা ছিল। বনগাঁও এক মাস প্রশিক্ষণ শেষ করে, প্রথম অপারেশনে গেলেন লেফটেন্যান্ট মোমিনুল হক চৌধুরী। স্থানটি ছিল ময়মনসিং জেলার কামালপুর বর্ডার এলাকা। আমাদের ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন সাহেব বাছাইকৃত ৯ জন সৈনিককে নিয়ে, প্রথম শত্রুদের এলাকা পর্যবেক্ষণ (রিকি)/ (শত্রুর এলাকা আগে থেকে ভালোভাবে জানা) করতে গিয়েছিল জামালপুর বর্ডার এলাকয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে।
রিকি করে ফেরার সময় দু’জন পাকিস্তনি জোয়ান সেনাকে ধরে নিয়ে আসে। আমাদের মনে সাহস এবং উৎসাহ যোগাতে। তাদের হাত দুটো উচু করে ধরে বেঁধে রাখে এবং তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। এর দু-দিন পর আমাদের সিদ্ধান্ত হয় কামালপুর বর্ডার এলাকায় পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করা হবে, যুদ্ধ করা হবে। এরপর কামালপুর বর্ডারের ক্যাম্পের একটু দূরে আমাদের (কমন্ডোকে লক্ষ করে একসাথে লাইন ধরে চলা) আছার লাইন হয়। এর পরপরই আমরা শত্রুদেরকে অ্যাটাক করি। আমরা সামনের দিক থেকে অস্ত্র দিয়ে গুলি বর্ষণ করি এবং পিছন থেকে মর্টার থেকে গোলা মারতে থাকে। পিছন থেকে যে গোলা মারা হচ্ছিল, বৃষ্টির হবার কারনে সেগুলো দিকবিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছিল এবং কিছু কিছু গোলা আমাদের নিজেদের গায়াও লাগছিল। ওই যুদ্ধ করাটা আমাদের একটু ভুল ছিল, সেটা হচ্ছে ওখান থেকে দুজন পাকিস্তানি সেনাকে ধরে নিয়ে আসার পর তারা সবাই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। তারা আগের থেকে আরও শক্তি সঞ্চয় করে তারা প্রস্তুতি ছিল। তারপরও আমাদেরকে যেভাবে নিয়ে যাওয়া হলো আমরা সাহসের সাথে মৃত্যুর ভয় না করে দেশ স্বাধীনের জন্য একে একে লাইন ধরে কামালপুর ক্যাম্প আক্রমন করতে থাকি।
যুদ্ধে উল্লেখ যোগ্য কিছু ঘটেছিল?
জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে আমরা যুদ্ধ করতে করতে সামনের দিকে ছুটলাম। পথের মধ্যে যেতে যেতে অর্ধেক পথ পেরোতেই তিন দিক থেকে শত্রুরা প্রতিরোধ শুরু করেছিল। সেখানে তারা ব্যাপকভাবে সৈন্য মোতায়ন করে রেখেছিল, কিন্তু আমরা সেটা জানতাম না। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওখানে ঢোকার পর-পরই আমাদের উপর তারা আক্রমণ করে, তখন আমাদের ওখানে ৭০ থেকে ৮০ জন সৈনিক শহীদ হয়। ওই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন সাহেবও শহীদ হন। তিনি প্রথমে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে ফায়র করতে থাকে। হঠাৎ তার বুকে গুলি লেগে শহীদ হন। ওখানে এমন পরিস্থিতি সৃষ্ঠি হয়েছিল, আমরা আমাদের বন্ধুদের লাশটা পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারেনি। তারপরও আমরা ওখান থেকে যুদ্ধ করতে করতে পিছন ফিরে আবার ব্রাকে চলে আসি।
কোথাথ কোথায় যুদ্ধ করেন?
প্রথমে ময়মনসিং জেলার কামালপুর বর্ডার এলাকায়। এরপর ভারতের আমবাছা নামে একটা গারো পাহাড়ের এলাকায় ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে আসা হয়। ওখানে আমরা দীর্ঘ দুই মাস ধরে প্রশিক্ষণ নিতে থাকি। আমবাছা ক্যাম্পে আমাদের মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের বললেন, আমরা কি সারাবছর এই ক্যাম্পে বসে বসে খাব? না আমরা দেশের মানুষকে বাঁচাবো? দেশের মানুষ সব মরে শেষ হয়ে গেল! আমাদের এখন যুদ্ধে নামতে হবে। তখন আমরা সবাই এক বাক্যে স্লোাগান দিতে থাকি। আমরা বাংলাদেশে ঢুকব যুদ্ধ করব মরন হলে বাংলাদেশের মাটিতেই মরবো, কিন্তু যুদ্ধ করব দেশকে স্বাধীন করবোই!
এরপর ভারতের সীমানা থেকে পাহাড়ারের কোল ঘেঁষে জঙ্গল। সেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমাদেরকে লম্বা লাইন করে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়ি। তখন আমাদের সাথে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও ছিলেন। তিনি সর্বত্র আমাদের লাইনের সামনে ছিলেন। এবং তিনি অচেনা পথকে সামনের দিক থেকে (র্যাকি) করতে করতে আমাদের নিয়ে গেলেন। সারাদিন হাঁটতে-হাঁটতে যাওয়ার পর আমরা বিকালের দিকে সামনের দিক থেকে বিভিন্ন গোলাবারুদের কলরবের শব্দ শুনতে পায়। তখন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ওরা প্রথমে আমাদের উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি আর্মিরা জানতে পেরে গেছিল, ভারত থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল আসছে যুদ্ধ করার জন্য। তারা আমাদের প্রতিরোধ করলেই সামনা সামনি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমাদের সৈনিক ছিল অনেক এবং অস্ত্রগুলো সংরক্ষিত অস্ত্র যার কারণে তারা প্রথমেই আমাদের সাথে পারে না। যুদ্ধ করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এভাবে জিয়া উদ্দীন ও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে শত্রু ঘাটি ধ্বংস করি এবং আস্তে আস্তে আগাতে থাকি। পাকিস্তানি সেনারা পিছন দিকে পিছতে থাকে। এভাবে যুদ্ধ করতে করতে আমরা সিলেট শহর পর্যন্ত চলে যায় এবং বিপুল পরিমান পাকিস্তানি সেনাদেরকে হত্যা করি।
যদ্ধে আপনার কোন বন্ধুকে হারিয়েছেন?
আমার সাথে থাকা যে বন্ধুরা ছিল তাদের ভিতর সবাই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। আমরা একসাথে হাই স্কুল থেকে ১৯ জন বন্ধু গিয়েছিলাম যুদ্ধে এবং বিভিন্ন স্কুল থেকে অনেক ছাত্র গিয়েছিলো। তারা অনেকে যুদ্ধে শহীদ হয়েছে।
কোন স্মৃতি গুলো বেশি মনে পড়ে?
ডিসেম্বরে যখন, সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জে এসে আমরা অস্ত্র পরিষ্কার করছিলাম। তখন দেখি আমাদের অফিসারদের সাথে পাকিস্তানি সেনারা আসছে। তারা সবাই সেনা অফিসার ছিল। তারা আত্মসমার্পন করেছিল। আমাদের অফিসারদের সাথে আসছে, তখন আমরা সবাই সম্মান দেখাতে তাদের কে স্যালুট দিচ্ছি! আমার তখন খুব খারাপ লাগছিল! যে পাকিস্তান বাহিনী আমাদের ভাইদেরকে হত্যা করছে, মা বোনদের ধর্ষন করেছে, তাদেরকে সম্মান দেখাচ্ছি, স্যালুট দিচ্ছি। তখন আমাদের অফিসার বলল, পাকিস্তান বাহিনীর ১০ হাজার সৈন্য আমাদের কাছে জিম্মি আছে। তারা আত্মসমর্পণ করেছে। সিলেটে ১০হাজার সৈনিককে আত্মসমার্পন করাতে সক্ষম হয়েছি।
কোন মজার ঘটনা ?
যুদ্ধ করতে করতে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের উপরে অ্যাটাক করেছে। আমরা এলএমজি দিয়ে কয়েকজন সৈন্যকে মেরে ফেলেছি তখন হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনারা জামা খুলে হাত উঁচু করে সাদা গেঞ্জি ঘোরাচ্ছে। আমাদের নির্দেশনা ছিল যদি পাকিস্তানি সেনারা সাদা কাপড় বা সাদা পতাকা উড়িয়ে হাত উঁচু করে রাখে তাহলে বুঝবে তারা আত্মসমার্পন করেছে। শত্রুকে আর মারা যাবেনা, যুদ্ধ করবে না। তখন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নিয় ওই বিষয়টি ছিলো মজার। সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে যখন হেরে যায় তখন তারা আত্মসমার্পন করতো।
স্বাধীনতার ঘোষণা কিভাবে পান?
স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার আগ মুহূর্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করে রেডিও শব্দ কানে আসে আমি মেজর জিয়া বলছি, তখন ২৬ শে মার্চ তিনি বললেন, এই মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। ভাষনটা বাংলা এবং ইংরেজিতে দিয়েছিলা। তিনি কার নেতৃত্বে এবং কার কথা মতন ভাষন দিয়েছিলেন আমরা জানি না। তবে তারপর থেকেই যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেছিল।
যুদ্ধের শেষ অবস্থা কেমন ছিল?
আমরা সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জ থেকে নদী পার হয়ে সিলেট হযরত শাহজালাল-এর মাজারের পাশে বিশাল এক খাওয়া-দাওয়া হয়। সেখান থেকে আমরা ঢাকা বনানী ক্যন্টনমেন্ট চলে আসি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু কে মুক্ত করে দেশে ফিরে আনা হলো, জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখে। তখন আমরা তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করলাম। ঢাকায় এসে আমরা মোহাম্মদপুর কলোনি দখল করলাম সেখানে আমরা অবস্থান করে পাহারা দেই, সেখানে সেকেন্ড বেঙ্গলের একজন কোম্পানি আর্মি লুকিয়েছিল, আসাদগেট কলোনির ভিতরে। তখন তাকে খুঁজে বের করে মেরে ফেলা হলো। তখন আমরা আরও সতর্ক হয়ে পড়ি এবং পুরো ঢাকা পাহারা দিতে থাকি।
উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ঘটেছিল?
আসাদগেট থেকে হঠাৎ শুনতে পায় পিলখানায় গোলযোগ হচ্ছে। ওখানে গোলাগুলি হচ্ছে। মুজিব বাহিনীর সাথে ইপিআর বাহিনীর মধ্যে মারামারি হচ্ছে। সেনাবাহিনীকে তারা তলব করলে আমরা তখন সেখানে ছুটে যায়। সেনাবাহিনীরা উভয় পক্ষকে ঘিরে রাখছিল এবং যুদ্ধ বন্ধ রাখতে মাইকিং করছিল। তখন মুজিব বাহিনী এবং ইপিআর বাহিনী অস্ত্র জমা দেয়। তখন আমরা সবার অস্ত্রগুলো কাঁধে করে অস্ত্রভান্ডারে জামা দিয়।
কিভাবে জন্মভূমিতে ফিরে এলেন? বাহিনীতে ফিরলেন না কেন?
আমরা তখন ছাত্র মানুষ, আমাদের দাবি ছিল যে আমরা ছাত্র আমরা তো চাকরি করতে আসেনি। আমরা দেশ স্বাধীন করতে এসেছি। বাঙালিকে মেরে ফেলছে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য আমরা নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি। আমাদেরকে লেখাপড়ার সুযোগ দিতে হবে আমরা চাকরি করবো না। তখন আমাদেরকে ঘিরে বিশাল এক বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। তখন আবু সাঈদ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাকে প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠান হল।
আমরা সেনা অফিসারদেরকে আমাদের পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনেরা বেঁচে আছে কিনা আমরা কেউ সেটা জানি না। আমরা এখন দেশে ফিরব মায়ের কোলে ফিরবো। নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরব। তখন আমাদের দুই মাসের ছুটি মঞ্জুর করা হলো। আমরা তখন তাদের অফিসারদেরকে বললাম যে আমরা এখানে চাকরি করতে আসিনি। আমাদের লেখাপড়া করতে হবে। তখন অফিসাররা বলল তোমরা তো লেখাপড়া করতে বাড়িতে যেতে চাচ্ছ। তোমরা এখান থেকে চলে গেলে আমাদের ব্যাটেলিয়ান খালি হয়ে যাবে। তবে তোমাদের শর্ত মানতে হবে। তখন আমাদের অনুষ্ঠানের এক বক্তৃতায় সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, হাফিজউদ্দিন সবাই কান্নাকাটি করছে এবং আমাদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করছে। তখন জিয়াউর রহমান তার বক্তব্যে বলছেন, তোমরা যাবে কিন্তু তোমরা বাড়িতে ফিরে লেখাপড়া শিখে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের মত অফিসার হয়ে আসবে এবং তোমরাও একজন বড় বড় অফিসার হবে। এই কথা তোমাদের রাখতে হবে।
যুদ্ধ পরবর্তী দেশ কেমন পরিস্থিতিতে ছিল?
যুদ্ধের পর রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের দেখা দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই খারাপ অবস্থানে গেছিল দেশ। তখন দেশে খাদ্য সংকট মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। দেশে কঠিন দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষের দাফন-কাফনের জন্য এক টুকরো কাপড় পাওয়া যেত না। কলার পাতা দিয়ে মুড়ে মানুষকে কবর দিতে হতো। অনেকে না খেয়েও মারা গেছিল । সবমিলায়ে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ নানা ধরনের সমস্যার ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল।
সবশেষে তিনি বলেন, আমাদের প্রথমে এককালিন ২হাজার টাকা করে সম্মনী পেয়েছিলাম। এরপর মাসে ৩শত টাকা করে দিয়েছে। তারপর সরকার পরিবর্তন হবার পর ৫শত টাকা হয়। আবার যখন সরকার পরিবর্তন হয় তখন ১হাজার ৫শত টাকা,দুই বছর পর ৩হাজার টাকা এবং সর্বশেষ ৫টাকা করে। এরপর তত্বাবর্ধায় সরকার আসলে ১০হাজার টাকা সম্মানী দেয়। সর্বশেষ বর্তমান সরকার ২০ হাজার টাকা সম্মানী দিচ্ছে। এখন দেশে আমাদের অনেক সম্মান।