শারদীয়ার ছুটি, অতএব হাতে প্রচুর সময়। কেননা এবারতো আর পূঁজোর ব্যবস্থা নেই। তাই ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম, মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি পরিদর্শন করতে যাব। ২৭ সেপ্টেম্বর বৈকাল ৪টায় আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম। সম্পাদক নুরুল আলম ফরিদ, কর্মধ্যক্ষ মোঃ ইউসুফ, একজন মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ বাঙালি এবং আমি। কিছু দূর এগোতেই শেলিংয়ের শব্দ শুনতে পেলাম। গ্রামের লোকমুখে শুনলাম, মুক্তিবাহিনী বসন্তপুরের পাক ছাউনী আক্রমণ করেছে। মনে হলো ওই বিকটাকার শব্দগুলো যেন আমাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে। দ্রুত এগিয়ে চললাম। তখন রাত ৮টা। ঘাঁটির কাছাকাছি এসে পৌঁছালাম। এবার আমাদেরকে অতিসন্তর্পণে এগুতে হবে। কেননা দুই পক্ষেই গোলাগুলি হচ্ছে। অতএব এবার আমরা ক্রোলিং করে এগোতে লাগলাম। এমনভাবে কিছুদূরে এগোনোর পর ঘাঁটিতে এসে পৌঁছালাম। এর কিছুক্ষণ বাদেই গোলাগুলি থেমে গেল। আরও পরে ক্যাপ্টেন হুদা এবং ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা সমস্ত গায়ে কাঁদামাখা অবস্থায় ক্যাম্পে ফিরে এলেন, তার মুখেই শুনলাম বসন্তপুরে তিনি স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলতে সক্ষম হয়েছেন, দুঃসাহসী ক্যাপ্টেন এবং তার সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধায় স্বভাবতই মাথাটা নুয়ে এলো। মনে মনে বললাম, বাংলাদেশ আজ আর দুর্বল নয়। বাংলার এই দুর্জয় শক্তি, আমার জননী জন্মভূমিকে মুক্ত করবেই।
কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধার সাথে লাইনে বসে আহার পর্ব সমাধা করে তাঁবুর নীচে রাতের মত আশ্রয় নিলাম। ভোরের ঘুম ভাঙলে আবার সেই শব্দ। শুনলাম শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ দখল করার জন্য পাক সেনারা আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। হাত-মুখ ধুয়ে আসতেই ক্যাপ্টেন সাহেবের চায়ের টেবিলে ডাক পড়লো আমাদের। সবে গিয়ে বসেছি, ঠিক তখনই সংবাদ এলো পাক সেনারা পিরোজপুরে বাঙ্কার দখল করে নিয়েছে। তাই ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং গোলাবারুদ পাঠাতে হবে। দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। হঠাৎ আমরা স্থির করলাম এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো। ক্যাপ্টেন সাহেবকে বলায় তিনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন।
বেলা ১০টায় গিয়ে পৌঁছালাম শ্যামনগর থানার অদূরে পিরোজপুর নামক গ্রামে। আমাদের যেখানে ডিফেন্স ছিল তার থেকে দু’শ গজ দূরে শত্রু সৈন্য দাঁড়িয়ে। দেখলাম দু’শ গজ দূরে আমাদের বাঙ্কারের মধ্যে খান সেনারা। দুই পক্ষেই সমানে গোলাগুলি চলছে। শুনলাম এর মধ্যেই ৫০-৬০ জন রাজাকারসহ শত্রু সৈন্য খতম হয়েছে আমাদের অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে আমরা ৫শ’ গজ পেছনে সরে এলাম ঠিক চৌমাথার ওখানে। সেখান থেকেই থ্রিইঞ্চি মর্টার দিয়ে সেলিং শুরু করলেন ক্যাপ্টেন সাহেব। সমস্ত দিনটা সেখানেই কেটে গেল।
সবচেয়ে আশ্চার্যের যে, দুই পক্ষের সমানে গোলাগুলি চলছে, আর তার মধ্যেও গ্রামের জনগণ বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করে চলেছে। কেউ গোলাবারুদ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ মুক্তিবাহিনীর খাবার তৈরি করছে, আবার কেউ ডিফেন্স থেকে সংবাদ এনে দিচ্ছে। প্রতিটি জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে। হঠাৎ দেখলাম জনৈক মুক্তিযোদ্ধা কালীগঞ্জের দিক থেকে ছুটে আসছেন। কাছে আসতে জানতে পারলাম কালীগঞ্জে চার জন পাক সেনা খতম হয়েছে। ক্যাপ্টেন হুদা ধন্যবাদ জানালেন ওই সময়ের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে।
এক বৃদ্ধ এলেন কয়েকটি ডাব নিয়ে। এই বৃদ্ধের একমাত্র ছেলে ডিফেন্সে যুদ্ধ করছে। ছেলেকে না পেয়ে ডাবগুলো সব আমাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। ছেলের জন্য একটি রাখতে বলায় তিনি বললেন আপনারাতো আমার ছেলে। বৃদ্ধের দৃঢ় এই মনোবল সবাইকে মুগ্ধ করল। একজন তরুণ মুক্তিসেনা আহত হয়েছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে হবে তাকে হাসপাতালে। ভার পড়ল আমাদের ২-৩ জনের ওপর। অনিচ্ছা সত্বেও আহত সৈনিককে নিয়ে ফিরে চললাম দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর পরিত্যাগ করে। হে দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর তোমায় অভিনন্দন-বাংলার শক্তিকে, যারা শ্যামনগর মুক্ত রাখার জন্য জীবনপণ যুদ্ধ করে চলেছে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্যকে। কয়েকদিন পর জনৈক মুক্তিযোদ্ধা দুঃসংবাদ বহণ করে নিয়ে এলেন শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ হানাদাররা দখল করেছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মতো হয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম (কাজী মোতাহার রহমান রচিত খুলনার গণমাধ্যম ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ)।
আমার সোনার বাংলা কি তবে দখলদারদের থেকে মুক্ত হবে না ? ভাবনার অবসান করলেন মুক্তিযোদ্ধাই ভাবছেন কেন, এ তো সাময়িক পরাজয়, দেখবেন কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হব।”
তাছাড়া গেরিলাযুদ্ধের নিয়মই তো এমনি। এরপর কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর থেকে কী কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সরে এলেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলাম উত্তরে বললেন আমাদের সবচেয়ে অস্ত্রের অভাব, যার জন্য এ সাময়িক পরাজয়। আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে রাইফেল, এলএমজি, দু’একটি থ্রিইঞ্চি মর্টার আর ওরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, কাজেই ওদের মতো যদি আমাদের আধুনিক অস্ত্র থাকতো তো বুঝিয়ে দিতাম মুক্তিযোদ্ধারা কত দুর্বার।”
খুলনা গেজেট/এমএম