শাখারীকাঠি গণহত্যা দিবস আজ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের এই দিনে (৫ নভেম্বর-শুক্রবার) বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার শাখারীকাঠি বাজারে হানাদেয় রাজাকার বাহিনী।তখন অন্তত ৪৫ জনের মত মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে রাজাকাররা।তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক গবেষকের মতে এই সংখ্যা ছিল একশ ২৫ জনের উপরে। পরের দিন সকালে পার্শ্ববর্তী বিষখালী নদীর তীরে মরদেহ গুলো পুতে রাখা হয়। স্থানীয়রা এতই ভীত সন্ত্রস্ত ছিল যে স্বজনদের মরদেহগুলোর সৎকার করারও সাহস পায়নি তারা। স্বাধীনতার পর দেশ স্বাভাবিক হলেও, মুক্তিযদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাটিকে সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ ছিল না। জায়গাটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে শহীদদের স্মৃতি অম্লান করে রাখার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সরকারি স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের মত শহীদ পরিবার গুলোকে সম্মানিত করার দাবি নিহতের স্বজনদের।তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে এখানে ২০ শতাংশ জমির উপর মানসম্মত স্মৃতি স্তম্ভ নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানাযায়, স্বাধীনতার পরে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে ৩১ জন শহীদের নাম সম্বলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয় শাখারীকাঠিতে।কিন্তু রংক্ষনাবেক্ষন ও যত্নের অভাবে স্মৃতি স্তম্ভটির নামগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। নিচ থেকে পলেস্তারা খুলে যাওয়ার উপকৃম হয়ে গেছে। স্থানীয় লোকজন যত্রতত্র স্মৃতি স্তম্ভের গা ঘেষে মটরসাইকেল রাখছে। স্মৃতিস্তম্ভের জায়গাটি ব্যবহৃত হচ্ছে আনুসঙ্গিক অনেক কাজে।এখনই এই বধ্যভূমিকে সংরক্ষন না করা হলে এক সময় শহীদদের এই স্মৃতি চিহ্ন টুকুও হারিয়ে যাবে। কালের গহব্বরে ভুলে যাবে শহীদদের আত্মহুতির কথা।
গনহত্যায় নিহত মনিলাল দাসের ছেলে বৃদ্ধ আনন্দ লাল দাস বলেন, বাবাসহ এলাকার ৪৫ জন মানুষকে এক সাথে গুলি করে মারল রাজাকাররা। আমাকেও পিটিয়েছিল তারা। পরেরদিন বিষখালি নদীর তীরে নিয়ে মরদেহ গুলো পুতে ফেলে তারা। ভয়ে স্থানীয় কেউ সৎকারও করতে আসেনি।১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর অনেক কষ্টে বড় হয়েছি।কখনও সরকারি কোন সহযোগিতা পাইনি। এখন মরার সময় হয়ে গেছে। মরার আগে শাখারীকাঠি বদ্ধভূমিকে স্থায়ীভাবে রক্ষনাবেক্ষন এবং সরকারি ভাবে শহীদ পরিবার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
শহীদ মহাদেব চন্দ্র দাসের মেয়ে খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয় কর্মকর্তা অলোকা দাস বলেন, ঘটনার দিন ছিল আমাদের এখানের বাজার। আমার বাবা ছিলেন বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বিকেলে আমি বাবার কাছে এসেছিলাম খাবার খেতে। বয়সে অনেক ছোট থাকলেও যতদূর মনে পড়ে বন্ধুকধারী অনেক লোকজন এসে বাজারে থাকা সকলকে বেধে ফেলে। আমার বাবাকেও বেঁধে ফেলে তারা। পরবর্তীতে গুলি করে সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করে। বয়সে ছোট থাকায় হয়ত বেঁচে গেছি। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাদের সংসারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। মা ও চার ভাই বোনের লেখাপড়া ও খাওয়া একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। মায়ের অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে আমরা সবাই মোটামুটি লেখাপড়া শিখে কর্মজীবনে ঢুকে পড়ি।যদি বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়ত আমাদের এত কষ্ট হত না।আমাদের ছাত্রজীবনেই জীবীকার তাগিদে কাজ করতে হত না। বাবা মরেছেন ঘাতকের বুলেটের আঘাতে।সারা জীবনের জন্য বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরা। এখন আমাদের বয়সও প্রায় শেষ পর্যায়ে। বেঁচে থাকতে থাকতে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে মর্যাদার সাথে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই। আমি আশা করি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতদেরকে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করবেন।
শুধু এরা নয় অন্যান্য নিহতের স্বজনদেরও একই দাবি সরকারি স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে শহীদের মর্যাদা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মত সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হোক।
স্থানীয় বৃদ্ধ দেলোয়ার শিকদার বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এখানে লাইন দিয়ে এত লোক মারাপ হল। কিন্তু ৯০ এর দশকে তৈরি করা হলেও জায়গাটি এখনও অরক্ষিত রয়েছে। জায়গাটিকে সংরক্ষণ করে শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই।
স্থানীয় আরও কয়েকজন বলেন, স্বাধীনার পর থেকে এই জায়গাটিতে গণহত্যা হয়েছে এমন কোন চিহ্নও ছিল না। ১৯৯৮ সালের দিকে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়। কিন্তু সেটিও এখন ধ্বংসের দারপ্রান্তে। তাই আমাদের দাবি যতদ্রুত সম্ভব জায়গাটিকে সংরক্ষন করা হোক।
গনহত্যায় নিহত নকুল দাসের ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা নিমাই দাস বলেন, সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মানিত করেছেন, আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ।কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে অনেক মানুষ শহীদ হয়েছে। অনেক পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকেও মেরে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শহীদ পরিবারগুলো অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সরকারের কাছে দাবি জানাই সরকার যেন শহীদ পরিবারগুলোকে একটি স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করেন।
কচুয়া উপজেলা নির্বাহী জিনাত মহল বলেন, শাখারীকাঠির যেখানে বদ্ধভূমি রয়েছে। শহীদদের স্মরণে সেখানে ২০ শতাংশ জমির উপর একটি মনুমেন্ট করার প্রক্রিয়া রয়েছে। ইতো মধ্যে আমরা জমির স্কেচ ও আনুসঙ্গিক কাগজপত্র প্রস্তুত করে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষ পরবর্তী কাজ শুরু হবে।
খুলনা গেজট/এএ