কার্তিকের শুরুতেই শীতের বার্তা এলো শিশিরে। বছরের এসময়ে খেজুরের রস, গুড় ও পাটালির স্বাদ নিতে উদগ্রীব থাকে যশোরাঞ্চলের মানুষ। আর নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস খেতে গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের সমাগম ঘটে। দিন বদলের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলে যায়। কিন্তু যশোরের খেজুর গুড় ও পাটালির কদর আজো কমেনি। যে কারণে প্রবাদ আছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’।
বর্তমানে এর চাহিদা ও সুনাম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে পর্যন্ত গড়িয়েছে। শীতের ভরা মৌসুম না এলেও এরই মধ্যে রস সংগ্রহের জন্য গাছিরা খেজুর গাছ পরিচর্যা শুরু করেছেন। যশোরের খাজুরা অঞ্চলের দুই লক্ষাধিক খেজুর গাছ নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন গ্রামের মানুষ।
তবে বিভিন্ন পেশা বংশ পরম্পরায় চললেও গাছিদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। গাছির ছেলে হচ্ছে না গাছি। অবৈধ ইটভাটার আগ্রাসনে দিনকে দিন কমছে খেজুর গাছের সংখ্যা। যে কারণে এ বছরও যশোরে চাহিদা অনুযায়ী রস পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন গাছিরা।
খেজুর গুড় ও পাটালি তৈরির জন্য বিখ্যাত জেলার খাজুরা অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, মৌসুম শুরু না হতেই এ অঞ্চলে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়েছে। যারা গাছ কাটায় পারদর্শী তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় ‘গাছি’ বলা হয়। তারা কোমরে শক্ত মোটা দড়ি বেধে গাছের মাথায় উঠছেন। পিঠে ঝুলানো ঠুঙিতে থাকা ধারালো গাছিদা (দা) দিয়ে গাছের এক পাশের ডাল কেটে বের করছেন সোনালী অংশ। যাকে স্থানীয়রা চাঁচ দেয়া বলে। এর সপ্তাহ খানেক পরেই বাঁশের তৈরি নলি স্থাপন শেষে ঠিলে (মাটির ভাড়) পেতে রস সংগ্রহ করা হবে। সব মিলিয়ে নভেম্বর মাস থেকেই সুস্বাদু খেজুর রস আহরণ করতে শুরু করেছেন এখানকার গাছিরা।
যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা, ইছালী এবং বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ও জহুরপুর ইউনিয়ন নিয়ে খাজুরা অঞ্চল গঠিত। খেজুর গাছের আধিক্য থাকার কারণেই এ অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে ‘খাজুরা’। এর মধ্যে মোটাদানার বিশেষ পাটালি তৈরির জন্য লেবুতলা ইউনিয়নের বাওনডাঙ্গা ও তেজরোল গ্রামের দেশব্যাপী সুখ্যাতি রয়েছে। এ গ্রামে যারা পাটালি তৈরি করেন এমন কারিগর দেশের আর কোথাও নেই। এ পাটালি ও গুড়ের স্বাদই আলাদা। যা বিখ্যাত করেছে যশোরকে।
বন্দবিলা ইউনিয়নের কঠুরাকান্দি গ্রামের গাছি আবুল কালাম বলেন, গত ৪০ বছর যাবৎ এ পেশার সাথে যুক্ত আছি। মৌসুমের শুরুতে রস সংগ্রহের কাজ করি। কাঁচারস বিক্রির পাশাপাশি গুড় ও পাটালি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি।
ধর্মগাতী গ্রামের গাছি আক্তার মোল্লা বলেন, আগের তুলনায় খেজুর গাছের সংখ্যা অনেক কমেছে। নতুন করে গাছিও তৈরি হচ্ছে না। আর যারা গাছি আছেন, তাদের অধিকাংশই বয়সের ভারে আর গাছে উঠতে পারেন না। ফলে এ সেক্টরে বর্তমানে ব্রাপক সমস্যা বিরাজ করছে।
সফল পাটালি উৎপাদনকারী লেবুতলা ইউনিয়নের তেজরোল গ্রামের নাজিম উদ্দীন বলেন, মোটাদানার এক কেজি পাটালি তৈরি করতে কমপক্ষে ২শ’ টাকার বেশি খরচ হয়। কিন্তু আশানুরুপ দাম দিতে চায় না ক্রেতারা। এলাকার কিছু অসাধু মানুষ অল্প গুড় উৎপাদন করে তাতে অধিক চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করে তা কম দামে বিক্রি করে। এতে ভালো জিনিসের কদর থাকে না। ফলে প্রকৃত গাছিরা এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, অবৈধ ইট-ভাটার আগ্রাসনে আগের তুলনায় এখন খেজুর গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বনবিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে অবাধে ভাটা মালিকরা খেজুর গাছ কেটে ধ্বংস করে চলেছে। প্রাচীণ এই ঐতিহ্য রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
সদর ও বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলা এলাকায় ১০৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৮২টি এবং বাঘারপাড়ায় ২৬৫ হেক্টর জমিতে ৯২ হাজার ৭৫০টি খেজুর গাছ রয়েছে। যার রস থেকেই যশোরাঞ্চলের বিখ্যাত গুড় ও পাটালি উৎপাদন হয়ে থাকে।
বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া আফরোজ বলেন, গত বছর উপজেলার ৬০ জন গাছি নিয়ে একটি সংগঠন করা হয়। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উৎসাহ বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সড়কের পাশে অর্ধশতাধিক খেজুর গাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল। সেগুলো থেকে কয়েক বছর পরে রস সংগ্রহ করা যাবে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে চারা রোপণ করা হলে খেজুর গাছের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, যারা খেজুর গুড় ও পাটালি তৈরি করেন, তাদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে। এ বছরেও গুড়ে ভেজালরোধে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান চলবে। এছাড়া আসল গুড় ও পাটালির গুণাগুণ এবং ভেজালের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতনমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ড চালানো হবে বলে তিনি জানান।
খুলনা গেজেট/এনএম