বেসরকারি খাতের ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় সংলগ্ন গুলশান শাখার ভল্ট থেকে ১৯ কোটি টাকা উধাও হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শক দল গত সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) ব্যাংকটির শাখায় গিয়ে এমন তথ্য উদ্ঘাটন করেছে। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন ব্যাংকটির সব শাখার ভল্ট পরিদর্শন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতো বড় অনিয়মের তথ্য উদঘাটনের পরও শাখার কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের বা ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ওইদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শক দল ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা পরিদর্শনে যায়। সকাল ১০টার আগেই তারা শাখায় গিয়ে উপস্থিত হন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী শুরুতেই পরিদর্শক দল ভল্ট পরিদর্শন করে। কাগজে-কলমে শাখার ভল্টে ৩১ কোটি টাকা দেখানো হলেও সেখানে ১২ কোটি টাকা পায় পরিদর্শক দল। তাৎক্ষণিক বাকি টাকার বিষয়ে ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোনো জবাব দিতে পারেননি। উল্টো বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন তৎপরতা শুরু করে শাখা কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পক্ষও এ ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়।
প্রতিদিন লেনদেনের শেষ ও শুরুতে ভল্টের টাকা মিলিয়ে রাখার দায়িত্ব শাখার ব্যবস্থাপক, সেকেন্ড অফিসার এবং ক্যাশ ইনচার্জের। ভল্টে টাকার হিসাবে কোনো গরমিল হলে তা মিলিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব এসব কর্মকর্তার। অনেক সময় হিসাবের ভুলে সামান্য টাকার গরমিল হতে পারে। তবে বড় অঙ্কের টাকার গরমিল হলে তা ফৌজদারি অপরাধ। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। উল্টো মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাত পর্যন্ত পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার তৎপরতা চলে। শুধু তাই নয়, পরিদর্শনে গিয়ে যারা এই তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন, তাদের চাপে রাখা হয়। তবে অদৃশ্য কারণে এক্ষেত্রে কাউকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়নি। এমনকি থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরিও করেনি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। ব্যাংকের কারও বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে হোয়াসটঅ্যাপে লিখিত প্রশ্ন করা হলেও তিনি উত্তর দেননি।
বিষয়টি জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্টের টাকায় গরমিল হতে পারে। বিষয়টি আমি এখনও জানি না। তবে কেনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে এমন কোনো তথ্য পাওয়া গেলে অবশ্যই রুলস অ্যান্ড রেগুলেটরি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিভিন্ন সংকটে থাকা ব্যাংকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের উপর ভর করে চলছে। গত বছর শেষে ব্যাংকটির মোট আমানত ছিল ১৭ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতই চার হাজার ১২৭ কোটি টাকা।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত মে পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংকে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের আমানত ছিল ২১৭ কোটি টাকা, পদ্মা অয়েলের ১৫০ কোটি, যমুনা অয়েলের ১৫০ কোটি, চট্টগ্রাম ওয়াসার ৯২ কোটি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের ৯৮ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলার ৩২ কোটি, তিতাস গ্যাসের ১৫ কোটি টাকা। এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রাজশাহী, ইসলামী ফাউন্ডেশন, বিসিআইসি, বাখরাবাদ গ্যাস, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাংকে টাকা রেখেছে।
২০১৩ সালে যে ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশে অনুমোদন পায় সেগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড অন্যতম। প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মালিকানায় ছিল ব্যাংকটি। এখন ব্যাংকটি পরিচালনা করছে দক্ষিণাঞ্চলের একটি শিল্পগোষ্ঠী। সম্প্রতি পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। ব্যাংকটি আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৪২৮ কোটি টাকা উত্তোলন করবে। এজন্য ১০ টাকা করে কোম্পানিটি ৪২ কোটি ২৮ লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যু করবে। আইপিওর মাধ্যমে উত্তোলন করা অর্থ দিয়ে ব্যাংকটি এসএমই ও প্রজেক্ট অর্থায়ন, সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ও আইপিও খরচ খাতে ব্যয় করবে।
এর আগে চলতি বছরের ১৭ জুন ঢাকা ব্যাংকের বংশাল শাখার ভল্ট থেকে পৌনে ৪ কোটি টাকার সরিয়ে নেন এক কর্মকর্তা। ওই ঘটনায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ শাখাটির দুই কর্মকর্তাকে পুলিশ হেফাজতে দেয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এছাড়া কয়েক মাস আগে ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির একজন আইটি অফিসারও এক হাজার ৩৬৩টি লেনদেনের মাধ্যমে ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। ঘটনাটি ব্যাংকের অডিটে ধরা পড়ে।
খুলনা গেজেট/ টি আই