খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

জিলহজ মাসের প্রথম দশকের গুরুত্ব ও আমলসমূহ

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী

জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব । এই ১০ দিন অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এই ১০ দিনের মর্যাদা বোঝাতে মহান আল্লাহ পাক এ দিনগুলোর কসম খেয়ে বলেন, ‘শপথ প্রভাতের। শপথ দশ রাতের।’ (সূরা : ফাজর : ১-২)। এখানে যে দশ রাতের কথা বলা হয়েছে, তা হলো জিলহজের প্রথম দশ রাত।

জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম ১০ দিনের নেক আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয় কি? রসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও এর চেয়ে উত্তম নয়; তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে তার সর্বস্ব নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করল এবং কিছুই নিয়ে ফিরে এলো না।’ (বুখারি)।

আরবী ক্যালেন্ডারে চারটি মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মাস গুলো হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। এর মধ্যে চার মাস সম্মানিত।’ (সূরা তাওবা:৩৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদিস শরিফে ওই চার মাসের কথাই বলা হয়েছে। ইসলামপূর্ব যুগেও আরব দেশে এই চারটি মাস সম্মানিত মাস হিসেবে গণ্য করা হতো। এই চার মাসে সমস্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকতো। সম্মানিত এই চার মাসের মধ্যে জিলহজ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এই মাসেই পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয় এবং কুরবানি দেওয়া হয়। তাছাড়া এই দশকেই রয়েছে ঈদুল আযহা।

জিলহজের প্রথম দশকের বিশেষ আমল সমূহ :

১. নখ, চুল ও মোচ না কাটা :
জিলহজ মাসের চাঁদ উঠার পর থেকে নিয়ে চুল, নখ, মোচ, বগল ও অন্যান্য স্থানের লোম বা পশম না কাটা মুস্তাহাব বা উত্তম। এ সম্পর্কে উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জিলহজের চাঁদ দেখে এবং কুরবানির ইচ্ছা করে, সে যতক্ষণ কুরবানি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন চুল বা নখ না কাটে।’ (সহিহ মুসলিম)। যারা কুরবানি করতে সামর্থ্য রাখে না তারাও যদি এই ১০ দিন নখ, চুল, মোচ ও অন্যান্য পশম না কাটে তাহলে একটি কুরবানির ছওয়াব পাবে।

২. রোজা পালন করা : বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ ও মিশকাতের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা থেকে প্রমাণিত যে, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন কুরবানি করার আগ পর্যন্ত রোজা পালনসহ যে কোনো নেকির কাজ অধিক ছওয়াব ও ফজিলতপূর্ণ। এই সময়ের এক এক দিনের রোজা এক বছরের রোজার সমতূল্য বলে হাদিসে এসেছে। বিশেষ করে জিলহজ মাসের ৯ তারিখে আরাফার দিনের রোজা অতীব ফজিলতপূর্ণ। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, আরাফার দিনের রোজা আগের ও পরের এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে।’ (মুসলিম)। তবে আরাফায় অবস্থানকারী হাজীদের জন্য রোজা রাখা উত্তম নয়। কেননা মহানবী (সা.) আরাফায় অবস্থান করেছিলেন রোজাবিহীন অবস্থায়।

৩. হজ ও ওমরাহ সম্পাদন করা : হজ ও ওমরাহ এ দুটি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারাস্বরূপ, আর কবুল হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’ (বুখারি ও মুসলিম।) যারা করোনা মহামারির কারণে এবার হজে যেতে পারছেন না, তারা বেশী বেশী তওবা এস্তেগফার করবেন এবং মজবুত নিয়ত রাখবেন যে, সুযোগ পাওয়া মাত্রই কালক্ষেপণ না করে হজ আদায় করে ফেলবেন।

৪. বেশী বেশী জিকির করা : এ দিনগুলোয় জিকির-আযকারের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যেন নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর স্মরণ করে।’ (সূরা হজ: ২৮)। বিশিষ্ট মুফাসসির সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, এ নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন।’ এই দিনগুলোতে বেশী বেশী তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহমিদ (আলহামদু লিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) পড়া সুন্নত। হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এ ১০ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহ আকবার) ও তাহমিদ (আলহামদু লিল্লাহ) বেশী বেশী করে পাঠ করো।’ (বায়হাকি: শুআবুল ঈমান)।

৫. কুরবানি করা : এই মাসের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো কুরবানি করা। প্রাপ্তয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়তি ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

৬. তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা : জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে নিয়ে ১৩ তারিখের আসরের নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। নারী-পুরুষ সবার জন্য ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা কর্তব্য। চাই নামাজ জামাআতে হোক, কিংবা একাকি পড়া হোক। এ তাকবির একবার পাঠ করা। তাকবিরে তাশরিক হলো, ‘আল্লাহ আকবার, আল্লাহ আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহ আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’ তাকবিরে তাশরিক পুরুষরা উচ্চ স্বরে আর মহিলার স্বশব্দে নিচু স্বরে পড়বে যেন মহিলাদের তাকবিরের শব্দ কোন গাইরে মাহরাম লোক না শোনে।

আমাদের উচিত, জিলহজ মাসের বিশেষ ফজিলত পাওয়ার জন্য নির্ধারিত আমলগুলো সঠিকভাবে আদায় করা। আল্লাহ তা’আলা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে জিলহজ মাসের নির্ধারিত আমলগুলো যথাযথভাবে পালনের মাধ্যম কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত ছওয়াব ও বরকত হাসিল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!