খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

গণমাধ্যমের শত্রুরা

মঞ্জুরুল আলম পান্না

আগামী এক দশকের মধ্যে মুক্ত সাংবাদিকতা যে কতোটা ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে, তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর মহাসচিব ক্রিস্টোফার ডেলইয়র সম্প্রতি বলেছেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো যেভাবে স্বাধীন সাংবাদিকদের টুটি চেপে ধরে গণমাধ্যমকে সেন্সরশীপের মধ্যে নিয়ে আসছে, তাতে আগামী ২০৩০ সালে সাংবাদিকতার ভয়াল চিত্র নিয়ে এখনই প্রশ্ন তুলতে হবে’।

সংস্থাটির মতে, ‘মুক্ত গণমাধ্যমকে ধ্বংস করতে যা যা প্রয়োজন, বিশ্বজুড়ে তার সবই শুরু হয়ে গেছে’। আগামী এক দশকে গণমাধ্যমকে ধ্বংস করতে প্রভাবক হিসেবে যে বিষয়গুলো কাজ করবে বলে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের আগ্রাসনের কারণে ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কট, গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে প্রযুক্তিগত সংকট, দমনমূলক নীতির কারণে রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং সর্বোপরি গণমাধ্যমের প্রতিই মানুষের আস্থার সংকটের সৃষ্টি। মুক্ত সাংবাদিকতা বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার শেষোক্ত যে ‘কারণ’ অর্থাৎ গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থার যে সংকট, সেখান থেকেই গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের ঘৃণারও সৃষ্টি হয় ধীরে ধীরে।

গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি এবং সহিংসতা এখন একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে দেশে সাংবাদিকদের উপর হামলার রূপগুলোতে বৈচিত্র এসেছে। গোপন নজরদারি, সেন্সরশীপে বাধ্য করার পাশাপাশি গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রধান একটি অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনী মারপ্যাচ, তার সঙ্গে থাকছে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত করার অর্থনৈতিক অবরোধ। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ২০২১ সালের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান বাংলাদেশের এক ধাপ উপরে, ১৫০ তম। যখন তখন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণসহ কড়া নিবর্তনমূলক আইনের খড়গে প্রথম শ্রেণীর সংবাদমাধ্যমগুলোর টুটি চেপে ধরা হয়েছে। এক সময়ের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ায় গণমাধ্যমের অস্তিত্বই এখন সংকটের মুখে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সদ্য শেষ হওয়া শাসনামলে সাংবাদিকদের প্রতি নিয়মিত চিৎকারে গালিগালাজের কাহিনীতো সবার জানা। তুরস্ক এবং মিশরে ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটির নতুন বিস্তৃত সংজ্ঞা এমনভাবে করা হয়েছে যার অধীনে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধাচরণ করা যে কোন সাংবাদিককে আটক করার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডসহ ১৫০টিরও বেশি রাষ্ট্রে সাংবাদিকদের দমিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে যত্রতত্র দায়ের হচ্ছে ‘মানহানির মামলা’। এই মানহানির মামলা করছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজ এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বিশেষ বা সেই ব্যক্তি বিশেষের দালাল শ্রেণীর মানুষেরা।

বৃটিশ গণমাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয় আইনী পরিচালক গিল ফিলিপস তার সম্প্রতি তার একটি লেখায় বলেছেন, ‘গত কয়েক বছরে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ভয়াবহ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে সরাসরি রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের নির্দেশে, বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্রে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে সৌদি সরকারের নির্দেশে হত্যা করার ঘটনা তার একটি দৃষ্টান্ত’।

ভারতে সংশোধিত তথ্যপ্রযুক্তি আইন সরকারকে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে সংবাদমাধ্যমের বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা যায়। বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও অনুরূপ একটি আইন, যা অদৃশ্যভাবেই রোধ করছে গণমাধ্যমের কণ্ঠ। এই মামলার খড়গ নেমে এসেছে অনেক সাংবাদিকের মাথায়, যার সর্বশেষ শিকার ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক তানভীর হাসান তানু। এর আগে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

গণমাধ্যমের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র বা সরকার কতোটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স তার বিশ্লেষণ তুলে ধরলেও গণমাধ্যমের জন্য গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরাই যে কতোটা হুমকি হয়ে উঠছে তা বলেনি। সাংবাদিক রোজিনার ওপর নির্যাতন নিয়ে সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজসহ সারাদেশকে যেভাবে ফুঁসে উঠতে দেখলাম, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একই রকম নির্যাতনের শিকার অন্য কোন সাংবাদিকের বেলায় কিন্তু আমরা তেমনটা দেখিনি কখনও। রোজিনা নির্যাতনের বিরুদ্ধে এতোখানি আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনের কারণ তিনি প্রথম আলোর মতো একটি বনেদি পত্রিকার সাংবাদিক। তাই প্রতিবাদের ভাষার বৈষম্যও এখানে প্রকট হয়ে ওঠে।

দেশের প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার চরম স্খলিত রূপ আমরা দেখলাম মুনিয়া হত্যাকান্ডে বসুন্ধরার এমডির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে। শীর্ষ স্থানীয় একটি গ্রুপ অব কোম্পানীর লোভনীয় বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে সেই অভিযুক্ত এমডি’র নামই প্রথম দু’দিন প্রকাশের সাহস পেল না কোন সংবাদমাধ্যম। অনেকেতো উল্টো মুনিয়ারই চরিত্র হরণে উঠে পড়ে লাগলো। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, এমন অনেক সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরণের বাঁধা না থাকলেও অধিকাংশ গণমাধ্যম এখন চলছে তুমুল সেল্ফ সেন্সরশিপে। সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার বদলে নিজের চেয়ার ঠিক রাখতে মালিক পক্ষের বিভিন্ন অনৈতিক ব্যবসায়িক স্বার্থের দেখভাল, বিজ্ঞাপনের লোভ সামলাতে না পারা, নিজের আখের গোছাতে জনগুরুত্বসম্পন্ন অনেক সংবাদ চেপে যাওয়াই এখন অধিকাংশ সম্পাদক/সিনিয়র সাংবাদিকের মূল কাজে পরিণত হয়েছে।

তাছাড়া আামাদের গণমাধ্যম জগতে ভয়াল অন্ধকার সৃষ্টির অন্যতম কারিগরের ভূমিকায় রয়েছেন কথিত কিছু সাংবাদিক নেতা। দলীয় লেজুরবৃত্তিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে বিভাজিত সাংবাদিক নেতাদের হালুয়া-রুটির উচ্ছিষ্ঠ ভোগের মানসিকতা গণমাধ্যমে নগ্ন হস্তক্ষেপের মোক্ষম সুযোগ করে দিচ্ছে প্রতিটি সরকারকে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলো তার চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণে গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরবে, এতে কি অবাক হওয়ার কিছু আছে? কিন্তু গণমাধ্যমের টুটি খোদ গণমাধ্যমকর্তারাই কতোটা চেপে ধরছে, সেটিই বরং এখনকার আলোচনার প্রসঙ্গ হওয়া উচিত।

চলতি দশকে স্বাধীন সাংবাদিকতা অনেক বেশি বিপর্যস্ত হয়ে ওঠার পেছনের যেসব কারণ তুলে ধরেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, তার শেষেরটিই (লেখার শুরুতে উল্লেখিত) এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে। গণমানুষের একটি বড় অংশের মাঝে এরই মধ্যে গণমাধ্যমের প্রতি সৃষ্টি হয়েছে অনাস্থা এবং ঘৃণার। একদিকে ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু, অন্যদিকে এক শ্রেণীর সিনিয়র সম্পাদক বা সাংবাদিকের হলুদ সাংবাদিকতার কারণে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য থেকে। সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সাধারণ মানুষ ঝুঁকে পড়ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মানহীন অনেক সংবাদ কিংবা গুজবের প্রতি।

এ কথাতো সত্য যে, গণমাধ্যমের পথ কখনও মসৃণ ছিলো না, এখনও নেই, আগামীতে হবে আরও কঠিন। তবু জানি, এই ঘনঘোর অন্ধকারে অনেকে বেশি যুদ্ধ করেই টিকে থাকবে প্রকৃত সাংবাদিকতা, টিকে থাকবে সমাজ আরও অনেক অনেক দিন।

মঞ্জুরুল আলম পান্না : সাংবাদিক




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!