‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা
কে বলে আজ তুমি নেই
তুমি আছো মন বলে তাই।’
খুলনা বেতারের আয়নার কারিগর আমাদের অচিন্ত কুমার ভৌমিক। পরপারের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর নশ্বর দেহখানি আমাদের ছেড়ে প্রকৃতির নিয়মে চলে গেল। কিন্তু তিনি কি যেতে পারলেন? তিনি রয়ে গেলেন আয়নার কারিগর হয়ে। ছুরোত, ইজ্জত, ময়না ভাবি কখনও মরে না। তাই আমাদের মাঝে আয়নার কারিগর হয়ে বেঁচে আছেন ছুরোত, ইজ্জত, ময়নার রূপকার অধ্যাপক অচিন্ত কুমার ভৌমিক। তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াবে ছুরোত, ইজ্জত, ময়নার মধুর ঝগড়াঝাটি। তারই মাঝে আমরা খুঁজে পাবো একজন অচিন্ত কুমার ভৌমিককে। আমরাও যেদিন তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরপারে চলে যাবো সেদিনও তিনি থাকবেন। তিনি তো আয়নার কারিগর।
খুলনা বেতারের দীর্ঘদিনের সেই ‘আয়না’ অনুষ্ঠান যারা শুনেছেন তারা সকলেই হয়তো আমার সাথে একমত হবেন। ছুরোত, ইজ্জত ও ময়না ভাবি খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় আমাদের মনের কথা বলতেন। তারা আমাদের সমস্যা আমাদের ভাষায় সাবলীলভাবে তুলে ধরতেন। শুধু সমস্যার কথা তুলে ধরলেই তা মানুষের কোন কল্যাণ বয়ে আনে না, সমস্যার সমাধানের পথ দেখিয়ে তারা মানুষের হৃদয় জয় করতেন। কৃষকের ফসলের ক্ষেতে পোকা লাগলে ছুরোত আলীর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেতো। সারাদিন ফসলের ক্ষেত পরিচর্যা করে সন্ধ্যায় এসে ইজ্জত ও ময়না ভাবির সাথে পরামর্শ করতো। খুলনা এলাকার সকল কৃষক সেই পরামর্শ শুনে ফসলে পোকা দমনের পথ খুঁজে পেতো।
ময়না ভাবি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের সমস্যা চিহ্নিত করতেন, আর সন্ধ্যায় তার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতো ছুরোত ও ইজ্জতের সাথে। গ্রামের মহিলারা কাজের মাঝে তাদের আলোচনা শুনে নিজেদের সমৃদ্ধ করতেন। সকল শ্রোতাই মনে করতেন, ময়না ভাবি তাদেরই বিভিন্ন সমস্যার কথা বলছেন। দেশের ও এলাকার কোন সমস্যা তাদের নজর এড়াতো না। সমাধানের পথও তারা দেখিয়ে দিতেন।
ছুরোত, ইজ্জত ও ময়না ভাবির ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। তাদের সেই ঝগড়াঝাটি সকলের হৃদয় জয় করে সৃষ্টিশীলতায় ভরে তুলতো। আঞ্চলিক ভাষায় এত মধুর ঝগড়া আর কখনও হয়তো কেউ শুনতে পাবে না। আয়নার কারিগর পরপারে বসে হয়তো আরো নতুন নতুন ঝগড়ার সৃষ্টি করে আকাশপথে ময়না ভাবির কাছে পাঠিয়ে দিবেন, আমরা এই আশায় থাকবো।
ময়না ভাবি ছাগল পালন করতে গিয়ে মাঝে মাঝে প্রতিবেশীর গালি খেতেন। তার ছাগলে প্রতিবেশীর ফসল খেলে ঝগড়াঝাটি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু তার জন্য তিনি মন খারাপ করে বসে না থেকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতেন। তার সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি শুনে সকল মহিলারা উপকৃত হতেন।
ছুরোত, ইজ্জত আর ময়না ভাবি ছিলো সমসাময়িককালের আদর্শ মডেল। তাদের কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি সকল মানুষের দৃষ্টি কেড়ে হৃদয়ে আসন করে নিয়েছিল। তখনকার শ্রোতারা ছুরোত, ইজ্জত ও ময়নাকে না দেখেই তাদের কাল্পনিক ছবি হৃদয়ে ধারণ করতো। রাস্তাঘাটে, চায়ের আড্ডায়, উঁচুতলায়, নিচুতলায় সবখানেই ছুরোত, ইজ্জত ও ময়না ভাবি বিরাজ করতো। এখানেই তাদের স্বার্থকতা, এখানেই তাদের বিজয়। এইসব সার্থক চরিত্রের নেপথ্য নায়ক ছিলেন অধ্যাপক অচিন্ত কুমার ভৌমিক।
প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক প্রয়াত হূমায়ুন আহমেদ তাঁর কল্পনা দিয়ে সৃষ্টি করে গেছেন হিমু, মিছির আলী, বাকের ভাইয়ের মতো কালজয়ী চরিত্র। সকল বাংলাভাষী মানুষ সেইসব কালজয়ী চরিত্রের মাঝে নিজেকে কল্পনা করে। তাদের কথা মনে করতে করতে অসংখ্য মানুষ কখনও ‘হিমু’ সেজে হলুদ পাঞ্জাবি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ঘুরে বেড়ায়, কেউবা ‘মিছির আলী’ সেজে রমনা পার্কে বসে নানাবিধ প্রশান্তি অনুভব করে। আবার হয়তো পাড়া মহল্লার কোন উঠতি মাস্তান বাকের ভায়ের কথা মনে করে মাস্তানি না করে ভাল কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। এসবের মূল উদ্যোক্তা কিন্তু তিনিই যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন। এইসব কালজয়ী চরিত্র সৃষ্টিকারীরা যুগ যুগ ধরে মানুষের ভিতরে বেঁচে থাকবেন। তাঁদের সৃষ্ট চরিত্রগুলি মানুষের আদর্শ হয়ে সাহিত্য ও সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করবে। কালজয়ী চরিত্রের রুপকার এইসব মানুষেরা সকল শ্রেণীর মানুষের চোখের সামনে না থাকলেও অনন্তকাল ধরে মানুষের হৃদয়ের গভীরে বেঁচে থাকবেন। তেমনই একজন কালজয়ী সার্থক চরিত্র রুপকার অধ্যাপক অচিন্ত কুমার ভৌমিক।
আমি এখন বাংলাদেশ বেতার খুলনার প্রযোজনায় ‘আয়না’ অনুষ্ঠানে আছি।
ময়না ভাবি : ও সুরোত ভাই, ও ইজ্জত ভাই। তুমরা কিডা কনে আছো, আমারে তাড়াতাড়ি ফুলতলায় নিয়ে চলো। আমার পরাণ ফাটে যাচ্ছে। আমি আর থাকতি পারতিছি না। আমি অচিন্ত দাদারে ইট্টু শেষ দেহা দেখতি চাই। আমারে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো।
সুরোত : আমিও যাবো। আমিও থাকতি পারতিছিনে। কিন্তু সে ইজ্জত এহনও আসে পারিনি। অফিসির সামনে রেডিওর সব স্যারেরা গাড়ি নিয়ে দাড়ায়ে আছে। গাড়ি ছাড়ে দিলি আমরা যাবানি কি এরে।
ময়না ভাবি : ঐযে পিয়ন আয়ছে। গাড়ি ছাড়ে দেচ্ছে। চলো যাই। ইজ্জত পরে আসবেনে।
ছুরোত : তাহালি রওনা দেও। ইট্টু পরেই পৌঁছে যাবানি। দাদারে দেহে মনডা জুড়াতি চাই। এইতো আসে গিছি। এইতো সব স্যারেরা এহানে আছে।
অচিন্ত দাদাও আছে। চোখ বুজে শুয়ে আছে। গলায় কত ফুলির মালা, কপালে চন্দন, হাজার হাজার মানুষ আজ দাদার বাড়ি আয়ছে। এট্টু পরে দাদারে নিয়ে যাবে। আমরা কি নিয়ে থাকবানি। ও ময়না ভাবি। তুমি কিছু কও। ইজ্জত এহনও আসলে না। সেতো মেলা কষ্ট পাবেনে। এখন কি এরি কওতো।
ময়না ভাবি : আমিও তাই ভাবতিছি। সারা দুনের মানুষ আসে গেছে, কিন্তু ইজ্জতের কি হলে তা কিডা জানে। আমার মনে কচ্ছে সে করোনার ভয়ে বাড়িরত্তে বারোইনি। বউ চাওয়াল মায়েরা হয়তো বারোতি দেচ্ছেনা। দেহা যাক, শ্মশানে নিতি আরো দেরি হবেনে।
ছুরোত : ও ময়না ভাবি। চায়ে দেহতো দাদার পায়ের কাছে মুহি মাস্ক বান্দে ইজ্জতের মতো কিডা যেন বসে বসে কানতেছে।
ময়না ভাবি : ঐতো আমাগে ইজ্জত। বেচারা কহন আসলে?
ইজ্জত : আমি তিন দিন আগে দাদার অসুকির কথা শুনে চলে আইলাম। অবস্থা খারাপ দেহে থাহে গিছি। আর যাতি মন চায়নি। কিন্তু দাদারে ধরে রাকতি পারলাম না। আমাগে ছাড়ে চলে গেল। আমি আজ তিনদিন ধরে দাদারে ছাড়ে একটুও নড়িনি।
ময়না ভাবি : কিন্তু হিন্দু সমাজের মানুষজনে কোন আপত্তি করিনি?
ইজ্জত : গোপনে গোপনে অনেকে করিলো। কিন্তু দাদা কইলো- ইজ্জত আমার সৃষ্টি। ও হিন্দু না, ও মুসলমান না, ও একজন মানুষ। দরকার হলে সে আমার মুখাগ্নি করবে। প্রয়োজনে ছুরোত ও ময়নাকে খবর দেও। ওরা তিনজনে আমার লাশ শ্মশানে নিবে।
এইকতা শুনে সগ্গলি চুপ হয়ে গেল। তারপর দাদার মুকতে আর কোন কতা ফুটিনি। এই কয়দিন আমি শুধু চামচ দিয়ে মুহি পানি দিছি আর কানতিছি। শেষে আমার হাতের পরে দাদা মাথা রাহে শেষবার আমার দিকি চায়ে চোক বুজলো। কয়েকদিন আগে তুমাগে দুইজনের কতা বার বার কইছিলো। তুমাগে দেহার জন্নি দাদার মনটা ছটফট করতিছিলো।
ময়না ভাবি : আমরা যা পারিনি তুমি তা করিছাও ইজ্জত ভাই।
ছুরোত : আমরা তুমার কাছে হারে গিছি। এহন আমাগে আর কেউ থাকলে না। আর কোনদিন আমরা ঝগড়াঝাটি করতি পারবো না। কিডা আমাগে ঝগড়া শিহেবে। এহন চলো দাদারে শ্মশানে নিয়ে যাই।
ইজ্জত : দাদা শেষ বেলায় আমার কানে কানে কয়ডা কতা কয়ে গেছে। আবারি কইলো, আমি মরার আগে এই কথাগুলো কারো কাছে কবিনা। আমি মরে গিলি তোরা তিনজনে আলোচনা করে তারপর সবারে শুনাবি।
দাদা মরার পর আজ আমরা তিনজনে প্রতম একসাতে হইচি। কতাগুনো তুমাগে কতি চাই।
ছুরোত ও ময়না : কও কও। তাড়াতাড়ি কও।
ইজ্জত : দাদা মরার আগে এক রাতি কেউ ছিলনা। শুধু আমি তাঁর মুখির কাছে বসে চামচ দিয়ে গালে এট্টু এট্টু পানি দিতিলাম। দাদা অতি কষ্টে চোখ খুলে চারিদিকি চায়ে আস্তে আস্তে কলে- বাড়ির সবাই ঘুমায় গেছে। তুই, আমি আর আমাদের সৃষ্টিকর্তা শুধু জাগে আছি। সেই মহান সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রাখে তোরে বলে গেলাম। এই দুনিয়ায় মানুষ সবার সেরা। সকল মানুষের মাঝে ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান বাস করে। সেরা হিসেবে মানুষের দায়িত্ব অনেক বেশি। সৃষ্টির সকল প্রাণী নিজ জীবন রক্ষা করলেই তার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু সকল সৃষ্টির সেবা করা একমাত্র মানুষের দায়িত্ব। তোরা তিনজন আমার সন্তান। সৃষ্টিকর্তার সকল সৃষ্টির সেবা করার দায়িত্ব তোদের উপর দিয়ে গেলাম। তোরা সারাজীবন সৃষ্টির সেবা করবি। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ করবি না। তোদের নাম আমি আব্দুল করিম, আব্দুর রহিম, মরিয়ম খাতুন কিম্বা হরেকৃষ্ণ, নারায়ন, হরিদাসী অথবা মাইকেল, দানিয়েল, মিলি রাখতে পারতাম। তাহলে কিন্তু তোরা যেকোন সম্প্রদায়ের হয়ে পড়তিস। এখন যেমন সবার আছিস, তেমন থাকতে পারতিস না।
তোর নাম ইজ্জত। তুই সমগ্র মানব জাতির মান- সম্মান, মর্যাদা সমুন্নত রাখবি। এজন্যই তোর নাম রেখেছিলাম ইজ্জত।
সুরোত মানে ‘মুখ’। মানুষের পরিচয় তার চেহারায় ও ব্যবহারে। আর চেহারা চেনা যায় মানুষের মুখ দেখে। তাই ওর নাম রেখেছিলাম ছুরোত।
ময়না আমার মেয়ে। ওটা একটা পাখির নাম। ময়না পাখির বুলি অতি মধুর। সে মানুষ ও সকল সৃষ্টিকে মধুর ভাষায় আমার কথা শুনিয়ে যাবে। আর তোরা তিনজনে মিলে একটা ‘আয়না’। মানুষ যখন নিজের ভুল বুঝতে পারবেনা তখন আয়নায় তোদের দেখে নিজের ভুল অনুধাবন করবে। ফিরে যাবে সঠিক পথে।
ময়না : আমি আর শুনতি পারতিছি না ইজ্জত ভাই। তুমার কথা থামাও। আজকের অনুষ্ঠান এহিনি শেষ।
(লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা)