৫ অক্টোবর ১৯৮৩, সকাল ৮:৩০টায় শীতের কুয়াশা চিরে দুটো চিৎকার ভেসে আসে। একটি ছিল গোলাম মুর্তজা স্বপনের স্ত্রী হামিদা রহমান বলাকা’র চিৎকার। অন্যটি এই দম্পতির বদৌলতে আসা নতুন প্রাণের। যে প্রাণ প্রবল চিৎকারে পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়, আমি এসেছি। আমি চলে এসেছি, রাজত্ব করবো বলে।
তিনি রাজত্ব করেছেন নিজ জেলা নড়াইলে। দস্যিপনায় মেতেছেন বন্ধুদের সঙ্গে। সেই দস্যিপনা টেনে এনেছেন সবুজ ক্যানভাসের বুকেও। গতির ঝড় তুলে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে একজন মাশরাফি বিন মুর্তজা আছে।
সেই মাশরাফি, বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার নায়ক আজ ৩৬ বছর পেরিয়ে ৩৭-এ পা দিলেন। এরমধ্যে ক্রিকেট মাঠেই কাটিয়ে দিয়েছেন দীর্ঘ ১৯ বছর। এই সুদীর্ঘ সময়ে ক্রিকেট মাঠে নিজের পারফরম্যান্সে, নেতৃত্ব গুণে বাংলাদেশকে দিয়েছেন অনেক আনন্দের এবং স্মরণীয় মুহূর্ত।
ক্রিকেটে মাশরাফির হাতেখড়ি নড়াইলে। শৈশবে দারুণ দুরন্তপনায় মত্ত মাশরাফির শুরুতে অবশ্য ফুটবল, সাতার এবং ব্যাডমিন্টনের নেশা ছিল। কিন্তু, ধীরে ধীরে ক্রিকেটের প্রতি প্রেম বেড়েছে। প্রথমে ব্যাটিংয়ে বেশি আগ্রহ থাকলেও বোলিং দিয়ে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছিলেন তিনি। এভাবেই নড়াইল হয়ে ঢাকার পথ ধরেন মাশরাফি।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে বলতে গেলে সংগ্রামই করা লাগেনি। খেলা লাগেনি কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচও। জাতীয় দলের জার্সি তাই গায়ে উঠেছে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ওয়ানডে জার্সিও গায়ে চড়িয়েছেন টিনেজ পেরোনোর আগেই। আর সেই সময়ে গতির ঝড়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে বেশ পারদর্শী ছিলেন মাশরাফি। ২০০১ সালে হ্যামিল্টনে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৮ কি.মি. গতিতে বল করে বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুততম বোলারের খ্যাতিও নিজের করে নিয়েছিলেন তিনি। সময়ের সঙ্গে হয়ে ওঠেন ক্রিকেট মাঠে সকলের প্রিয় মুখ।
তবে এরপরে ক্যারিয়ারে ইনজুরির হানা। যা দ্রুতগতির বোলার থেকে প্রায় মিডিয়াম পেসারই বানিয়ে দিয়েছিল তাকে। তবে ক্রিকেট থেকে দূরে রাখতে পারেনি মাশরাফিকে। বারবার আঘাত করা ইনজুরিকে হার মানিয়েছেন তিনি। নিজের সঙ্গে লড়াইয়ে জিতে মাঠে ফিরেছেন। মাশরাফি নিজেই জানিয়েছেন, ক্যারিয়ারে তিনবার ইনজুরিতে পড়ে মাঠে ফিরতে পারবেন বলে আশাই করেননি।
কিন্তু তিনি ফিরেছেন। তবে নিজের প্রিয় সাদা পোষাকের ক্রিকেটে সার্ভিস দিতে পারেননি বেশি। ২০০৯ সালে সর্বশেষ টেস্ট খেলেন। ইনজুরির জন্য এই ফরম্যাটকে বিদায় বলার আগে ৩৬ টেস্টে ৭৮ উইকেটের পাশাপাশি ৭৯৭ রান করেছিলেন।
টেস্টে সফল হতে না পারলেও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হিসেবে অবসর নিয়েছেন। টি-টোয়েন্টিতেও ছিলেন অসাধারণ। তবে ক্রিকেটার মাশরাফি নিজেকে আলাদা করে চেনাতে শুরু করেন ২০১৪ সালে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর। তবে ততদিনে কেবল সীমিত ওভারের ক্রিকেটই ভরসা মাশরাফির।
সেই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মাঝারি মানের বাংলাদেশ দলকে ক্রিকেট বিশ্বে আলাদা করে চেনাতে থাকেন। টাইগাররাও সমীহ আদায় করতে থাকেন মাশরাফির হাত ধরে। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ ২০১৫ সালে সর্বপ্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেন। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে নিয়মিতই হারাতে থাকেন। এই দলগুলোর বিপক্ষে সিরিজও জিতে বাংলাদেশ। এরপর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশকে সেমিফাইনালেও তোলেন অধিনায়ক মাশরাফি।
এরই মাঝে বিদায় নেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে। তার অধীনে বাংলাদেশ কুড়ি ওভারে ফরম্যাটে দেখেছে সর্বোচ্চ ১০ জয়। জিতেছেন বিপিএলে আলাদা ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে শিরোপাও। তবে কুড়ি ওভার ছেড়ে ওয়ানডেতে ফোকাস দিতে থাকেন মাশরাফি। ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে পরিকল্পনা সাজান। বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশকে নতুন করে চেনানোর লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামেন অধিনায়ক মাশরাফি। বিশ্বকাপের আগে প্রথমবারের মতো ত্রিদেশীয় কোনো সিরিজের শিরোপা জেতেন। তবে বিশ্বকাপে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যর্থ হয় টাইগাররা।
মাশরাফিও ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে আসেন। বিশ্বকাপের পর কেবল জিম্বাবুয়ের সিরিজেই খেলেন জাতীয় দলের সবচেয়ে সফল এই ওয়ানডে অধিনায়ক। ৮৮ ম্যাচে দলকে ৫০ জয় উপহার দিয়ে নেতৃত্ব ভারও ছেড়ে দেন মাশরাফি। তবে ক্রিকেট এখনো ছাড়েননি। যদিও মাঠের ক্রিকেটে টাইগারদের এই মহানায়ককে দেখার সম্ভাবনা খুব কম।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই যোদ্ধা প্রায় ২০ বছরের ক্যারিয়ারে খেলেছেন ২২০ ওয়ানডে, ৫৪ টি-টোয়েন্টি এবং ৩৬ টেস্ট। যেখানে প্রায় ৩০০০ হাজার রানের পাশাপাশি ৩৯০ উইকেট রয়েছে তার নামের পাশে। এরমধ্যে টাইগারদের পক্ষে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ২৭০ উইকেট মাশরাফির।
এই মুহূর্তে নিজেকে অবশ্য রাজনীতির ময়দানে ব্যস্ত রাখছেন মানুষের জন্য। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নিজ জেলা নড়াইলের থেকে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন তিনি। করোনার এই সময়েও মানুষের জন্য কাজ করেছেন অসাধারণভাবে। নিজে করোনায় আক্রান্তও হয়েছেন। তবে যোদ্ধা মাশরাফি হার মানতে জানেন না। করোনাকেও হার মানিয়েছেন তিনি। এই মুহূর্তে ক্রিকেট নয় মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন।
টাইগার ক্রিকেটের এই মহানায়কের ৩৭তম জন্মদিনে, তার প্রতি কোটি ভক্তের পক্ষ থেকে একটাই চাওয়া, ‘ভালো থাকো মাশরাফি।’