খুলনা, বাংলাদেশ | ৪ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৯ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  রাজধানীর উত্তরা থেকে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গ্রেপ্তার
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৬ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১০৮৩
  ১৬ ডিসেম্বর ঘিরে কোনো ধরণের হামলার শঙ্কা নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

৯ শতাংশ জমির জন্য মাকে জবাই করে শেফালী

গে‌জেট ডেস্ক

গাজীপুরের শ্রীপুরে বরমী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া গ্রামে গভীর জঙ্গল থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাত নারীর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দীর্ঘ তদন্ত শেষে এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে একমাত্র মেয়ে শেফালী ও তার সহকর্মী সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করেছে শ্রীপুর থানা পুলিশ।

জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে শেফালী জানায়, মাকে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে বুকের ওপর বসে দুই হাত দিয়ে মাথা ও গলা টান দিয়ে ধরলে সোহেল ছুরি দিয়ে জবাই করে। পরে মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত হলে সহকর্মীকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসে তারা।

শুক্রবার (৪ মার্চ) সকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক মো. আমজাদ শেখ এ তথ্য জানান। এ সময় কালিয়াকৈর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আজমীর হোসেন ও শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।

শেফালী ও সোহেল রানা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) গাজীপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহমেদের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

হত্যাকাণ্ডের শিকার মা মিনারা বেগম (৫৭) শ্রীপুর পৌরসভার ভাংনাহাটি গ্রামের আবু তাহেরের স্ত্রী। মাকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার একমাত্র মেয়ে শেফালী (৩৫) গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পূর্ব খন্ড (পুকুরপাড়) গ্রামের মো. ফরিদের স্ত্রী। সহকর্মী সোহেল রানা (২৫) শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী থানার খড়িয়াকাজিরচর গ্রামের মেরাজ উদ্দিনের ছেলে। শ্রীপুরের বিজিবেড গার্মেন্টসে শেফালী ও সোহেল চাকরি করতেন।

পুলিশ জানায়, মিনারা বেগমের বিয়ের পর জন্ম হয় একমাত্র মেয়ে শেফালীর। স্বামী আবু তাহের পরিবারিক কলহের জেরে শেফালীর জন্মের বছর কয়েক পর স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে অন্যত্র চলে যান। মিনারা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে শেফালীকে আদর যত্নে বড় করেন। প্রায় ২০ বছর আগে গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পূর্ব খন্ড গ্রামের চাঁন মিয়ার ছেলে মো. ফরিদের সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেন। বিয়ের পর শেফালী-ফরিদ দম্পতির ঘরে তিন ছেলে জন্ম হয়। শেফালী স্থানীয় বিজিমেড নামে একটি কারখানায় চাকরি ও স্বামী ফরিদ অটোরিকশা চালাতেন। সামান্য বিষয় নিয়ে শেফালী ও ফরিদের সংসারে প্রায়ই কলহ লেগে থাকতো। এ নিয়ে শেফালী তার মা মিনারা বেগমের বাড়ি পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর পৌর এলাকার ভাংনাহাটি গ্রামে থাকতেন। মিনারা বেগমের সম্পদের মধ্যে বাবার রেখে যাওয়া ৯শতাংশ জমি সম্বল ছিল। মিনারা বেগমের অন্য কোনো ওয়ারিশ না থাকায়, জীবিত থাকা অবস্থায় জমিটি যাতে বিক্রি করতে না পারেন, তাই আট বছর আগে ওই জমিটি একমাত্র মেয়ে শেফালীকে উইল করে দেন। সবশেষ এই জমিটির জন্যই একমাত্র মেয়ের হাতে নির্মমভাবে খুন হতে হলো মিনারা বেগমকে।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া গ্রামের সাধুখার টেক এলাকার গভীর জঙ্গল থেকে অজ্ঞাতনামা গলকাটা মরদেহ উদ্ধার করে শ্রীপুর থানা পুলিশ। এ ঘটনায় ওই দিনই থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। পরে মামলাটি তদন্ত করে শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক মো. আমজাদ শেখ। পাশাপাশি র‌্যাব, সিআইডি, পিবিআইর বিশেষজ্ঞ দল মরদেহের পরিচয় শনাক্ত ব্যর্থ হয়। ক্লুহীন মামলাটি পুলিশে বিভিন্ন আঙ্গিকে তদন্ত শুরু করে।

এরই মাঝে খবর আসে দেলোয়ারা বেগম নামে এক নারী মিনারা বেগমের নিখোঁজের বিষয়ে অভিযোগ দায়েরের জন্য শ্রীপুর থানায় আসেন, তিনি নিখোঁজ মিনারার ছোট বোন। পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আমজাদ অজ্ঞাতনামা ওই নারীর ছবির সাথে বোন দেলোয়ারার দেখানো ছবির মিল পান। এ সময় দেলোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে শেফালী ও ফরিদকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযানে নামে পুলিশ। গত ২ মার্চ পুলিশ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে সকাল ১১টায় ফরিদ ও বিকেল ৪টায় শেফালীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে শেফালী তার অপর সহকর্মীর সহযোগিতায় লাখ টাকার চুক্তিতে মাকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। শেফালীর দেওয়া তথ্য মতে ৩ মার্চ ভোরে শেফালীর সহযোগী সোহেল রানাকে ভাংনাহাটি এলাকা থেকে আটক করে ঘটনাস্থলের পাশের একটি পুকুর থেকে হত্যায় ব্যবহৃত একটি চাকু উদ্ধার করা হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক মো. আমজাদ শেখ জানান, শেফালীর সংসারে টাকার দরকার হলে বিষয়টি মা মিনারাকে জানান। বাবার কাছ থেকে পাওয়া প্রায় ৯ শতাংশ জমি ও দুইটি গরু বিক্রি করে টাকা দেওয়ার জন্য মিনারা বেগমকে চাপ দেয় শেফালী। এতে মিনারা বেগম রাজি না হওয়ায় শেফালীর সাথে মিনারার ঝগড়া হয়। মিনারা রাগ করে চড় থাপ্পড় মেরে শেফালীকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে সে ক্ষুব্ধ হয়ে মা মিনারা বেগমকে হত্যার পরিকল্পনা করে। মাকে হত্যার জন্য তার সহকর্মী সোহেল রানাকে বিষয়টি জানায়। মিনারাকে হত্যা করতে ১ লাখ টাকা দাবি করেন সোহেল রানা। এতে শেফালী রাজি হয়ে সোহেলকে ১৫ হাজার টাকা অগ্রীম দেন এবং বাকি ৮৫ হাজার টাকা কাজ শেষে দেবে জানিয়ে তারা মিনারাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১০ ফেব্রুয়ারি শেফালী তার মা মিনারাকে বন ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ শোনার কথা বলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মায়ের বাড়ি থেকে বের হয়। শেফালী তার মাকে নিয়ে কেওয়া এলাকার সিআরসি মোড়ে সোহেলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এরপর সোহেল আসলে মা ও মেয়েসহ তিনজন একটি অটোরিক্সা ভাড়া করে ওয়াজ শোনার কথা বলে উপজেলার বরমীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে সোহেল একটি সেভেন আপের (কোমলজাতীয় পানি) মধ্যে কিছু চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে মিনারাকে খেতে দেন। সেটি খাওয়ার পর মুহুর্তেই মিনারা অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তারা বরমীর ভিটিপাড়া গ্রামের সাধুখার টেক এলাকার গভীর জঙ্গলের কাছে পৌঁছে অটোরিক্সাকে ছেড়ে দেয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে শেফালী ইট দিয়ে তার মায়ের মাথায় আঘাত করে। তারপর শেফালী তার মাকে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে বুকের ওপর বসে দুই হাত দিয়ে মাথা ও গলা টান দিয়ে ধরলে সোহেল ছুরি দিয়ে জবাই করে। এরপর মিনারার মৃত্যু নিশ্চিত হলে সোহেল ঘটনাস্থলে পাশের একটি পুকুরে ছুরিটি ফেলে দিয়ে চলে আসেন।

কালিয়াকৈর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আজমীর হোসেন বলেন, সামান্য বিষয় নিয়ে মেয়ে তার মাকে হত্যা করতে পারে এমন ধারণাই ছিল না পুলিশের। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশ একটি ক্লুলেস হত্যা মামলার রহস্য সফলভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!