১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ইতিহাস, ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আর ২০২৫ সালে এসে ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুখে আবেগময়ী কথা শুনে আবেগআপ্লুত হন বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিদেশিরাও।
দুর্ভিক্ষ থেকে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ইতিহাস শুনে দেশি-বিদেশী উদ্যোক্তা আর বিনিয়োগকারীরা উচ্ছাসও প্রকাশ করেন।
বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত দুদিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। সম্মেলনে ৫০টি দেশ থেকে ৫০০ এর মতো বিনিয়োগকারী অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বিদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই বাংলাদেশ আপনাদেরও বাড়ি। একটি সুন্দর বাংলাদেশ গঠন করার দায়িত্ব আপনাদেরও।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, লাখো প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আমাদের কমিটমেন্ট ছিল আমরা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলব।
৭৪’ সালের দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ হয়। সেই দুর্ভিক্ষে মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। ওই ঘটনায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। এ দুর্ভিক্ষের কথা জাতি ভুলে যায়নি। দুর্ভিক্ষে মানুষের করুণ মৃত্যুর বর্ণনা শুনে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদেরও বারবার চোখ মুছতে দেখা যায়।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালের চোরাচালান ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক আকতার উল আলমের লেখা ‘দুঃশাসনের ১৩৩৮ রজনী’তে উল্লেখ করেছেন, ‘দীর্ঘ ৩টি বছর আমরা এমনটি প্রত্যক্ষ করেছি যে, আমাদের চোখের সামনে চাল-পাট পাচার হয়ে গেছে সীমান্তের ওপারে, আর বাংলার অসহায় মানুষ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে।’
বাংলাদেশের ওই সময়ের দুর্ভিক্ষ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান তথ্য-অনুসন্ধানী সাংবাদিক ‘জন পিলজার’ লিখেছেন, ‘সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে এবং আমাদের গাড়ি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম- এর লরীর পিছনে পিছনে চলছে। এই সমিতি ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডা. আব্দুল ওয়াহিদ জানালেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়ত কয়েক জন বিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি। কিন্তু এখন মাসে অন্তত ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি- সবই অনাহার জনিত মৃত্যু”।
বাংলাদেশের চুয়াত্তরের দুর্নীতি ও ভয়াল দুর্ভিক্ষ নিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার প্রোভার্টি এন্ড ফেমিনেস’ বইয়ে লিখেছেন, ‘সেসময়ে দুস্থ মানুষকে বিনামূল্যে খাবার খাওয়ানোর জন্য প্রায় ৬ হাজার লঙ্গরখানা খুলতে হয়েছিল। সেখানে প্রায় ৪৪ লাখ মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও রাজনীতিবিদদের লুটপাটে সাধারণ মানুষের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে পড়েছিল। খাদ্য আমদানীর ওপর নির্ভরশীল সরকার দেশে তীব্র দুর্ভিক্ষ হওয়া সত্বেও খাদ্য শস্য আমদানীতে সাফল্য দেখাতে পারেনি।’
কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ইতিহাসধর্মী উপন্যাস ‘দেয়াল’-এ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর বেলায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বাকশাল প্রধান ও দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বেশকিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে দুর্নীতি ও দুর্ভিক্ষকে প্রধানতম কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের শাসনামলের দুর্নীতি ও অনিয়মগুলোকে তিনি সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন বইটিতে।