শেখপাড়া এখন বাণিজ্য কেন্দ্র। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ২০নং ওয়ার্ডের একটি মহল্লা। এক সময় ছিল নজরুলনগর ইউনিয়নের মধ্যে। পাকিস্তান জামানায় শেখপাড়া এলাকায় মুসলিম লীগের সমর্থক ছিল অনেক বেশি। মুসলিম লীগের প্রার্থীরা এই এলাকা থেকে উল্লেখযোগ্য ভোট পেতেন। পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুস সবুর খান এর আদি নিবাস খুলনা হওয়ার কারণে শহরের অধিকাংশ এলাকায় মুসলিম লীগের সমর্থনের পাল্লা ভারী ছিল। মুসলিম লীগের সভা সমাবেশ এবং মিছিলের আয়োজন হলে এই এলাকায় বেশি সাড়া পড়ত।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী ছিল শেখপাড়ায় হাতেগোনা কয়েকজন। ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি মরহুম শেখ শহিদুল ইসলাম শেখপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন। তার ব্যক্তি ইমেজের কারণে ছাত্রলীগের সমর্থকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে দুই পাকিস্তানের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগের সমর্থকরা বোঝাতে চেষ্টা করে ছয় দফার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করতে চায়। শেখপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের সমর্থক বাড়ানোর জন্য স্থানীয় কর্মীরা দলীয় প্রধানকে এই এলাকায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান খুলনা সফরে এলে তাকে শেখপাড়ায় আনা হয়। তিনি খুলনায় এলে মাঝে মধ্যে তার বাল্যবন্ধু ডালমিল মোড় এলাকার অধিবাসী নওশের আলী চৌধুরী ওরফে নসু চৌধুরী অথবা বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের নূরনগর, স্বাধীনতা পরবর্তী শেরেবাংলা রোডের বাসভবনে থাকতেন।
১৯৬৬ সালের কথা (মহানগর আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শেখ ফজলুল হকের সাক্ষাতকার)। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে শেখপাড়া মেইন রোডের মোনায়েম হোসেন জোয়ার্দ্দারের বাড়ীর পেছনে একটি প্যান্ডেল করা হয়। তখনকার দিনের প্যান্ডেল আজকের মত এত আধুনিক ছিল না। রাস্তার ওপরে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি তোরণ করা হয়। মুসলিম লীগের কর্মীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে তোরণটি সমাবেশের আগের দিন ভোরে উধাও করে দেয়। কোথায় নিয়ে লুকানো হয় তার সন্ধান পাওয়া যায়নি এবং এই চুরির সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের নামও পাকিস্তান আমলে কোনদিন প্রকাশ পায়নি। পরবর্তীতে জানা যায় গেট উধাও করার সাথে জড়িতরা হচ্ছে ইসলাম কমিশনার, সাব্বির আহম্মেদ, মোঃ ইলিয়াস, ইরফান কন্ট্রাকটার, খোরশেদ আহম্মেদ ও আবুল কাশেম সরদার।
বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে শেখপাড়ায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়। মুসলিম লীগের কর্মীরা বাড়ী বাড়ী ঘুরে শেখ মুজিবের সমাবেশে না আসার জন্য এলাকাবাসীদের নানাভাবে হুমকি দেয়। এলাকার মানুষের মধ্যে কৌতুহল ছড়িয়ে পড়ে। সবাই বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নগর আওয়ামী লীগের এই নেতা উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু যখন শেখপাড়া এলাকায় আসেন তাকে এক নজর দেখার জন্য গৃহবধূরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অনেকেই প্রত্যাশার প্রহর গুণতে থাকে কখন পৌঁছাবে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিব। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথারীতি শেখপাড়ায় এসে কর্মীসভায় বক্তৃতা করেন।
বক্তৃতা দান কালে তিনি বলেন, শেখপাড়ার সাথে যেন তার নাড়ির সর্ম্পক। শেখপাড়ার কর্মীসভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষ্যমের কথা তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন পূর্ব পাকিস্তানে পাট চাষ হয়, অথচ এখানকার চাষীরা ন্যায্য মূল্য পায় না। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হচ্ছে তাই না, আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার জোরে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ আসছে তাও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হচ্ছে। এখানকার সমাবেশে ময়লাপোতা, পল্লীমঙ্গল, সোনাডাঙ্গা, শিববাড়ী এলাকায় রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরা দলে দলে এসে যোগ দেয়। অধিকাংশ মানুষ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষ্যমের বিষয়টি স্পষ্ট বুঝতে পারে। নিজেদের প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধুর শেখপাড়ার সমাবেশের পর এখানে আওয়ামী লীগের সমর্থন বাড়তে থাকে।
এই সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ ছাড়াও স্থানীয় সংগঠক শেখ মোসলেম উদ্দিন, খান মোশাররফ হোসেন ও শেখ ফজলুল হক বক্তৃতা করেন। স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল হক উল্লেখ করেন, তিনি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির শুরু থেকেই জড়িত। তার দেয়া তথ্যমতে, পাকিস্তান জামানায় খুলনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা হচ্ছেন, শেখ আব্দুল আজিজ, এ্যাডঃ মোমিন উদ্দিন আহমেদ, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, মোঃ এনায়েত আলি, হাবিবুর রহমান খান, এম এ বারী, এ এইচ দেলদার আহমেদ, এ এফ এম আব্দুল জলিল, আলী হাফেজ, এমদাদুল হক মোল্লা, বেলায়েত হোসেন বাচ্চু, শামসুর রহমান মানি, মির্জা খয়বার হোসেন, ফজলুর রহমান খান, ডাঃ মুনসুর আলী, কুবের চন্দ্র বিশ্বাস, শ্রমিক নেতা অধ্যাপক আবু সুফিয়ান বীর উত্তম, এ্যাডঃ মঞ্জুরুল ইমাম, যুবনেতা শেখ আব্দুল সালাম, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুর রহমান জাহিদ প্রমূখ।
ছয় দফা প্রচারে খুলনায় জনসভা
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তার আমুল পরিবর্তন ঘটে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বাঙালি ঘুরে দাঁড়ায়। ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট জেঃ আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে বাঙালির কন্ঠকে স্তব্ধ করতে চায়। তখন বিরোধী দল বলতে আওয়ামী লীগ। আর এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে ফেডারেল সরকারের অঙ্গ রাজ্য হিসেবে পরিণত করতে চান। স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি তোলেন। এ দাবিতে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নিকট থাকবে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র ব্যতীত সকল বিষয়। পৃথক অর্থনীতি, পৃথক মুদ্রা ও পৃথক প্যারামিলিটারীসহ পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন থাকবে। আর এ লক্ষ্যেই তিনি ছয় দফা প্রণয়ন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ফসল ছয় দফা। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯ জেলায় ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। ছয় দফা শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য সৃষ্টি। বাঙালির প্রাণের দাবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরায় শেখ সাহেবের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি এবং তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বি নেতায় পরিণত হন।
১৯৬৬ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোর সম্মেলনে ছয় দফা উপস্থাপন করা হয়। উভয় পাকিস্তানে সাড়া পড়ে। ঢাকার দৈনিক আওয়াজ পত্রিকায় ছয় দফা প্রকাশিত হয়। ছয় দফা প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ছয় দফা প্রশ্নে সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। খুলনায়ও তার কিছু অনুসারী ছিল। যারা ছয় দফার বিরোধিতা করেন। তার মধ্যে অন্যতম ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ঐতিহাসিক মরহুম এএফএম আব্দুল জলিল। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ জাতীয় কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ ও সাধারণ সম্পাদক মোমিন উদ্দিন আহমেদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত হন।
ন্যাপ এর সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও ছাত্র ইউনিয়ন ছয় দফাকে সমর্থন করেনি। ন্যাপ প্রধান ছয় দফা সিআইএর কারসাজি বলে চিহ্নিত করেন। তার উক্তি ছিল ছয় দফায় কোন অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেই। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে লাভ হবে না। খুলনা জেলা ন্যাপের সভাপতি ও অধুনালুপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান এ্যাডঃ আব্দুল জব্বার ও আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস ছিলেন এই মতের অনুসারী। তারা ছয় দফার বিপক্ষে অবস্থান নেন।
১৯৬৭ সালে ১২ ডিসেম্বর খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জে. মোঃ আইয়ুব খান উল্লেখ করেন বিরোধী দল পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রের ধ্বংস চায়। ছয় দফা ঘোষণার পর সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দায়ের করেন। (সিরাজ উদ্দিন আহমদ রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)
১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা অনুমোদনের পর বিকেলে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রাষ্ট্রদ্রোহী ভাষণ দেয়ার অভিযোগে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য খুলনার মিউনিসিপ্যাল পার্কে (আজকের শহীদ হাদিস পার্ক) আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছয় দফার সমর্থনে পার্কের মঞ্চের সামনে ছয়টি প্রতীকী কামান তৈরী করা হয়।
খুলনা গেজেট/ এস আই