শুল্ক বিভাগের কোনো না কোনো কর্মকর্তার যোগসাজশে বিমানবন্দরের লকার থেকে ৫৫ কেজি সোনা চুরি হয়েছে—এ বিষয়ে তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন। এর মধ্যে দুজন কর্মকর্তাকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। সন্দেহের তালিকায় আরও দুজন কর্মকর্তা রয়েছেন।
মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, এই ঘটনায় রোববার মধ্যরাতে মামলা হওয়ার পর থেকেই পুলিশ তদন্ত শুরু করে। এরই মধ্যে শুল্ক বিভাগের দুজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। এর বাইরে শুল্ক বিভাগের চারজন সিপাহিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এই ঘটনায় করা মামলায় বলা হয়, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে শুল্ক বিভাগের ওই গুদামে বিভিন্ন পালায় (শিফট) দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুদ রানা, সাইফুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম ও আকতার শেখ এবং সিপাহি রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার।
মামলার তদন্ত তদারকিতে যুক্ত উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কেউ না কেউ এই সোনা চুরির সঙ্গে জড়িত। আমরা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। যাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে জব্দ করা, শুল্কের জন্য সাময়িকভাবে আটক করা বা চোরাচালানের মাধ্যমে আসা সোনাসহ অন্যান্য মূলব্যান সামগ্রী টার্মিনাল ভবনের নিচতলায় এই গুদামে রাখা হয়। এই গুদাম থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব হওয়ার ঘটনাটি গত শনিবার ঢাকা শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এরপর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শুল্ক বিভাগ। একই সঙ্গে রোববার রাতে বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। অবশ্য ঘটনা জানাজানির পর থেকেই পুলিশ ছায়াতদন্ত শুরু করে।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট পুলিশের একটি সূত্র বলছে, গুদাম থেকে সোনা চুরির ঘটনাটি শুল্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আরও দুই সপ্তাহ আগেই টের পেয়েছিলেন। এ কারণে তাঁরা গুদামে রক্ষিত মালামাল কাগজপত্রের হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার উদ্যোগ নেন। এরপর গত শনিবার হঠাৎ একটি লকার ভাঙা বলে খবর বের হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন পালায় এই গুদামে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন চারজন কর্মকর্তা। তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে সোনা জমা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় তালিকা দিয়েছেন। এমনকি এক সপ্তাহ থেকে চার মাসের মধ্যে আটক সোনার তালিকাও করে দিয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের দেওয়া তালিকার ভিত্তিতে অনেক সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু সোনা দীর্ঘদিন ধরে গুদাম থাকলেও সেসবের কোনো তালিকা এই কর্মকর্তারা দেননি। আর সেটা জানা গেল ৫৫ কেজি সোনা চুরি বিষয়টি ধরা পড়ার পর।
ঢাকা শুল্ক বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, কেন এসব সোনার তালিকা তৈরি করা হয়নি, সেটা ওই চার কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, অনেক দিন ধরেই গুদামের লকার থেকে সোনা সরানো হচ্ছিল। হিসাব মেলানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর চুরির ‘নাটক’ সাজানো হয়েছে। এর সঙ্গে দায়িত্বে থাকা কেউ না কেউ জড়িত, যাঁদের সঙ্গে বাইরের চোরাচালানকারী চক্রের যোগসূত্র থাকতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গুদামের বাইরের পাঁচটি তালা অক্ষত পাওয়া গেছে। গুদামের ভেতরের যে লকারটি ভাঙা পাওয়া গেছে, সেটার পাশে একটি কাটার (ধাতব পাত কাটার যন্ত্র) পাওয়া গেছে। সেই কাটার ব্যবহার করে গুদামের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের পাশে একটি অংশ কেটে রাখা হয়। বাইরে থেকে চোর গুদামে ঢুকেছে, এমনটা দেখাতে এটা করা হয়েছে। বাস্তবে ওই কাটা জায়গা দিয়ে কোনো ব্যক্তির ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়।
ঢাকা শুল্ক বিভাগের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ বলেন, একটি সন্দেহ থেকে গুদামে থাকা স্বর্ণের বার, অলংকারসহ মূল্যবান বস্তু ইনভেন্ট্রি (হিসাব মেলানো) করতে ৪৮ জন কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাঁরা কাজ শুরু করার পর যাঁরা চুরির করেছেন, তাঁরা ধরা পড়ার ভয়ে লকার ভাঙার নাটক সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি চাই তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসুক। জড়িতদের শাস্তি হোক।’
খুলনা গেজেট/এইচ