জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়া সেই এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ দুবাইয়ে নোঙর ফেলবে ২২ এপ্রিল। সেখানে পণ্য খালাসের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরই নাবিকদের দেশে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু করবে জাহাজটির মালিকপক্ষ। নাবিকরা যে যেভাবে আসতে চায় তাকে সেভাবেই দেশে আনবে মালিকপক্ষ।
জলদস্যুদের কবল থেকে নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত হওয়ার আগেই নাবিকেরা কে কোথা থেকে সাইন অফ (জাহাজের কর্ম হতে অব্যাহতি) করবেন, তার তালিকা চূড়ান্ত করে রাখে জাহাজের মালিকপক্ষ। তাদের নির্দেশে এ ব্যাপারে ক্যাপ্টেনকে একটি তালিকাও দিয়েছিল নাবিকরা। সেই তালিকায় জাহাজের ২৩ নাবিকের মধ্যে ১৮ জন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্দর থেকে সাইন অফ করবেন বলে জানিয়েছেন। বাকি পাঁচজন জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছালে সাইন অফ করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে এখন জাহাজের বেশিরভাগ নাবিক সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছেন। বেশিরভাগ নাবিকই এখন সেই এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে করে ফিরতে চান দেশে।
গত ১৪ এপ্রিল শ্বাসরুদ্ধকর এক জিম্মি ঘটনার অবসান হয় সোমালিয়ার উপকূলে। সেদিন ছোট্ট একটি উড়োজাহাজ বার বার চক্কর দিচ্ছিল জিম্মি থাকা এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চারপাশে। তখন ২৩ নাবিকের সবাই আসলেন জাহাজের ডেকে। হাত তুলে এক ভিডিও বার্তায় কথা বলেন তারা সবাই। ২৩ জন অক্ষত ও নিরাপদে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর মালিক পক্ষ মুক্তিপণের টাকা প্রদান করতে দেয় সম্মতি। এরপর ছোট্ট সেই উড়োজাহাজটি তিনটি চক্কর দেয় জাহাজের এক পাশে। প্রতিটি চক্করে সাদা পানি নিরোধক ট্যাপে মোড়ানো ডলার ভর্তি ব্যাগ ফেলা হয় উপর থেকে। দুটি স্পিড বোটে থাকা ৭ জন জলদস্যু এই তিনটি ব্যাগ সাগর থেকে তুলে নেয়। তারা ব্যাগ বুঝে পাওয়ার পর উড়োজাহাজটি চলে যায়। এর প্রায় আট ঘণ্টা পর বাংলাদেশ সময় শনিবার দিবাগত রাত তিনটায় জাহাজসহ ২৩ নাবিককে মুক্তি দেয় জলদস্যুরা।
১৪ বছর আগে জলদস্যুদের কবলে পড়া এমভি জাহান মণি জাহাজের ক্ষেত্রে ডলার ভর্তি দুটি ব্যাগ উড়োজাহাজ থেকে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এমভি আবদুল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যাগ ছিল তিনটি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সরাসরি কোন মন্তব্য করেননি কেএসআরএম গ্রুপের ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত। তিনি শুধু বলেন, ‘কোড অব কন্ট্রাক্টের কারণে আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত হয়েছে এটাই আমাদের বড় স্বস্তির জায়গা। মুক্তিপণ বিষয়ে দয়া করে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।’
সমঝোতার প্রক্রিয়ায় থাকা কেএসআরএম গ্রুপের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, পাঁচ মিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি হবে মুক্তিপণ। তবে আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি সঠিক নয়। এমভি জাহান মণির চেয়ে অনেক কম মুক্তিপণে (চার মিলিয়ন ডলারের চেয়ে কম) জাহাজটি ছেড়ে দিয়েছে দস্যুরা।
নাবিকদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী জিম্মি ঘটনার শুরু থেকে খোঁজখবর রাখছিলেন। তিনি বলেন, মুক্তিপণ কত তা কেবল জলদস্যু, বিমা প্রতিষ্ঠান ও জাহাজ মালিকরা জানেন। তারা যদি এটা গোপন রাখেন সঠিক তথ্য কেউ পাবেন না। কৌশলগত কারণে এটা প্রকাশ করে না তারা। ১৪ বছর আগে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হওয়া এমভি জাহান মনির টাকার অঙ্ক এখনো জানি না আমরা’। তিনি আরও জানান, এটি গোপন রাখার ব্যাপারে বিমা কোম্পানি জাহাজের মালিকপক্ষকে শর্ত দিয়ে রাখে। এটি কখনোই স্বীকার করবে না কোনো পক্ষ। তবে ঘটনা কিন্তু সত্য।
ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত এক দিন আগে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন ১৯-২০ এপ্রিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাবে জাহাজটি। এরপর নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এখন সেটি আরও দুদিন পিছিয়ে নির্ধারণ হয়েছে ২২ এপ্রিল। মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন নাবিকরা যে যেভাবে ফিরতে চান তাকে সেভাবে ফিরিয়ে আনবো আমরা।
কেএসআরএম’র সিইও মেহেরুল করিম বলেন, জাহান মণির সময় আমাদের জ্ঞানের অভাব ছিল। তখন উদ্ধারে সময় বেশি লেগেছিল। এবার জাহাজ দখলে নেওয়ার পর আমরা জাহাজের লোকেশন ট্রেক করতে থাকি। যোগাযোগও চলতে থাকে। তাই দ্রুততম সময়ে জাহাজটি মুক্ত করতে পেরেছি। দুবাইয়ে নোঙর করার পর ফেরার আনুষ্ঠানিকতার কাজ শুরু করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা।