২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের (খুবি) দুই শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃংখলা বাহিনী। ১৭ দিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে তাদের নির্যাতন করা হয়। ২৫ জানুয়ারি তাদের বিস্ফোরক দ্রব্যসহ গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। ওইদিনই তাদের খুলনার কৃষকলীগ কার্যালয় ও আড়ংঘাটা থানার গাড়ির গ্যারেজে বোমা হামলা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর একে একে তাদের বিরুদ্ধে আরও ৪টি মামলা করে পুলিশ। সেই থেকে গত ৫ বছর ধরে তারা কারাবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
সম্প্রতি খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা গ্রেপ্তার ও মামলাগুলোকে সাজানো এবং বানোয়াট বলে দাবি করেন। সহপাঠী, রুমমেট, শিক্ষক ও পরিবারের সদস্যরাও দুই ছাত্রকে নিরাপরাধ দাবি করে বক্তব্য দেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা হলেন খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী নূর মোহাম্মদ অনিক ও পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিনের ১৭ ব্যাচের মোজাহিদুল ইসলাম রাফি।
সংবাদ সম্মেলনে সহপাঠীরা বলেন, অনিক বিশ^বিদ্যালয়ে এসে তাবলীগে যুক্ত হয়। এজন্য সব সময় ইসলাম ধর্মীয় পোশাক পরতো, দাড়ি রাখতো এবং টুপি পরতেন। ছাত্র হিসেবে তারা দু’জনই মেধাবী ছিল। দীর্ঘদিন একসঙ্গে ক্লাস, গ্রুপ স্ট্যডি করার সময় কখনোই তাদের মধ্যে উগ্রতা দেখা যায়নি। ২০২০ সালে হঠাৎ তারা নিখোঁজ হন। ১৭ দিন পর তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাদের যে বাড়িতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তাদের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি। তাদেরও ভয়ভীতি দেখিয়ে জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। উদ্ধারের পুরো বিষয়টি সাজানো ছিল। পরে কারাগারে দেখা হলে অনিক ও রাফি জানায়, ১৭ দিন তাদের অজ্ঞাত স্থানে রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তাদের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুটি মামলায় খালাস, দুটি মামলায় জামিন এবং সোনাডাঙ্গা থানার দুটি মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কারাগারে তারা অনশন শুরু করেন। এর প্রেক্ষিতে দুটি মামলায় জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। সাজা হওয়া দুটি মামলায় উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু দুই বছর ধরে সেই আবেদনের শুনানি হচ্ছে না। জঙ্গি দোহাই দিয়ে সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
ছাত্রদের আইনজীবী আকতার জাহান রুকু বলেন, সম্পূর্ণ সাজানো তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সাজা দেওয়া হয়েছে। এই মামলার নূন্যতম কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। হাইকোর্ট নথি দেখেই জামিন দিয়ে দিবেন এবং মামলাও টিকবে না। সমস্যা হচ্ছে হাইকোর্ট এই মামলা শুনানি করতে রাজি হচ্ছে না। তিনি বলেন, ২০২২ সালে উচ্চ আদালতে আপিল করেছি। মামলাটি কললিস্টে রয়েছে। কিন্তু জঙ্গি মামলা শুনেই বিচারকরা এটা সরিয়ে দেন। বিষয়টি এটর্নি জেনারেলকে জানানো হয়েছে। এখন আইন ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হস্তক্ষেপ করলে বিষয়টির সুরাহা হতে পারে।
কারাবন্দি অনিকের স্ত্রী সুমাইয়া বলেন, আড়াই বছরের সংসার জীবনে কখনও জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়াতে দেখিনি। আমার ঘর থেকে যে সব উদ্ধার দেখানো হয়েছে, সেগুলো আমাদের ঘরে ছিলই না। লেবাসের (ধর্মীয় পোশাক) কারণে তাকে ফাঁসানো হয়েছে।
তিনি বলেন, গত ৫ বছর মামলা লড়তে লড়তে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫/২০ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। হাইকোর্টে অন্য দুই মামলায় জামিনের জন্য আইনজীবী ৪ লাখ টাকা চেয়েছে। অনেক কষ্টে সেই টাকা যোগাড় করার চেষ্টা করছি।
খুবির মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ আজহারুল ইসলাম বলেন, অনিক ক্লাসে নিয়মিত ছাত্র ছিল। পাশাপাশি সে আইসিএমএবি পড়তো। বিবাহিত হওয়ায় সে ব্যবসার জন্য একটি খাবারের রেস্তোরা দিয়েছিল। এমন নিয়মিত ছাত্ররা জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়াতে পারে এটা আমাদের বিশ^াস হয় না। সঠিক তদন্ত করে তাদের মুক্তির পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
দুই ছাত্রের সাজা হওয়া মামলা দুটি নগরীর সোনাডাঙ্গা থানায় দায়ের করা। গত ৫ আগস্টের পর থানার সব কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। থানার ওসিসহ অন্যরা মামলা দুটির বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। বিষয়টি খোঁজ নেওয়ার জন্য তারা ৭ দিন সময় চেয়েছেন।
খুলনা গেজেট/ হিমালয়