খুলনা, বাংলাদেশ | ৩০শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৪ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  সাড়ে ৫ ঘণ্টা পর হাত, পা বাঁধা অবস্থায় অপহৃত খাদ্য কর্মকর্তা উদ্ধার

১৪ জুলাই : দাবি আদায়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

বাসস

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই (রোববার) শিক্ষার্থীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়া ও কোটা সংস্কারের একদফা বাস্তবায়নের দাবি জানান।

এদিন সারাদেশে জেলা শহরগুলোতে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পদযাত্রা সহকারে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

আগের দিন বৈষম্যববিরোধী ছাত্র আন্দোলন রোববার কেন্দ্রীয়ভাবে বঙ্গভবন অভিমুখে পদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। পূর্বঘোষিত পদযাত্রার কর্মসূচিতে অংশ নিতে বেলা ১১টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন। বেলা ১২টায় সেখান থেকে পদযাত্রা শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে পদযাত্রাটি শাহবাগ, মৎস্য ভবন এলাকা হয়ে হাইকোর্টের সামনে আসলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়।

আন্দোলনকারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক দিয়ে বঙ্গভবন যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধ করার চেষ্টা করে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান ও স্লোগান শেষে শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভেঙে সামনের দিকে অগ্রসর হন। এরপর পদযাত্রা নিয়ে শিক্ষার্থীরা গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে পৌঁছালে পুলিশ আবারও ব্যারিকেড দিয়ে শিক্ষার্থীদের আটকে দেয়। সামনে অগ্রসর হতে না পেরে আন্দোলনকারীরা সেখানেই বসে পড়েন। একপর্যায়ে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটের দিকে জিরো পয়েন্টের ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনের দিকে অগ্রসর হন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা সামনে অগ্রসর হয়ে গুলিস্তান পাতাল মার্কেটের কাছে পৌঁছালে পুলিশ ফের তাদের গতিরোধ করে। সেখানে পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান প্রস্তুত রাখা হয়। এ সময় রাস্তা ব্লক ও বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। সেখানে এপিসি কার ও জলকামান নিয়ে শত শত পুলিশ সদস্য প্রস্তুত রাখা হয়।

পরে বেলা আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যান। প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। বিকাল ৩টার দিকে তারা বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসেন।

স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে (নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড) কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়। ওই বছরের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করা হয়। কিন্তু সেই পরিপত্রে দেশের শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। কারণ, শিক্ষার্থীরা সব গ্রেডের সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল। তাই শিক্ষার্থীদের দাবি-সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উলি¬খিত অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য কোটাকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে (সর্বোচ্চ ৫%) এনে সংসদে আইন পাশ করে কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে।

স্মারকলিপি প্রদান শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘স্মারকলিপিতে আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ২৪ ঘণ্টার একটি সুপারিশ করেছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদে অধিবেশন ডেকে আমাদের এক দফা দাবি বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা এ বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চাই।’

আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এটি আমরা আরও ২৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে দিচ্ছি। এর মধ্যে মামলা প্রত্যাহার করা না হলে, আমাদের কর্মসূচি আরও কঠোর হবে।’

নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের পর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে তাঁতীবাজার হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চলে যায় এবং আরেক অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে যায়।

এদিকে ১৪ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীরা দুপুর ১টায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা বিকেল ৩টায় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেন। এ সময়ে আনন্দ মোহন সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

শহরের পুলিশ লাইন্স থেকে বেলা ১১টায় পদযাত্রা নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি দেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন।

এদিন কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সংহতি সমাবেশ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যান। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন বেলা সাড়ে ১১টায় সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, বরিশাল সিটি কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা পৃথক মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেন। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল সাড়ে ১০টায় জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেন। বংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রংপুর সরকারি কলেজ, কারমাইকেল কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন।

এছাড়া ঝিনাইদহ, নাটোর, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, টাঙ্গাইল ও কুড়িগ্রামের চিলমারীতে পদযাত্রা, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।

এদিন সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ২৭ পৃষ্ঠার এ পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

এদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা না বুঝেই কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে। কোটা আন্দোলনে উসকানিদাতা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা মামলা তোলার যতই আল্টিমেটাম দিক, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে। মেরিট দেখেই মামলা করা হয়েছে।’

তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন,‘ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার বিষয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

‘বিএনপি ও সমমনারা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে’ বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এদিকে ১৪ জুলাই বিকেলে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। সমাধান হবে আদালতে।’

সংবাদ সম্মেলনে কোটা নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’

সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে সম্বোধন করায় শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের তীব্র প্রদিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা। এর প্রতিক্রিয়ায় সেদিন রাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেক মিছিল নিয়ে মধ্যরাতে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন। শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বের হওয়া শুরু করলে হলগুলোর ফটকে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কয়েকটি হলের ফটকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের আটকে রাখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোর পাশাপাশি রোকেয়া হল, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থীরাও এই বিক্ষোভে যোগ দেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’, ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’সহ বিভিন্ন স্লোগানে মধ্যরাতে ক্যাম্পাস উত্তাল করে তোলেন।

টিএসসিতে বিক্ষোভ শেষে রাত দেড়টার পর শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান। এর কিছুক্ষণ পর বুয়েটের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন। টিএসসি ঘুরে তারা মিছিল নিয়ে আবার নিজেদের ক্যাম্পাসে ফিরে যান।

এদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ করায় রাত সাড়ে ১১ টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এছাড়া এদিন রাতে ছাত্রলীগের তিনজন নেতা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সংগঠন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

খুলনা গজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!