বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল। এক পক্ষে ট্রাম্প, এক পক্ষে বাইডেন। জনগনের রায়ে বাইডেন আমেরিকার ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু বাইডেনের এই শপথ নেওয়ার আগেই আমেরিকার ২০৬ বছরের ইতিহাসে ঘটে গেল এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। নির্বাচন হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্পের অভিযোগ ছিলো নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, তাকে ষড়যন্ত্র করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফল মানতে ট্রাম্প নারাজ।
একে একে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ট্রাম্প শিবির প্রায় ৬১ টা মামলা করেছে কিন্তু প্রমানের অভাবে সবগুলো মামলায় আদালত খারিজ করে দিয়েছেন।তার পরও ট্রাম্প বলে যাচ্ছে কারচুপি হয়েছে। সর্বশেষ ট্রাম্প অপেক্ষায় ছিলেন আমেরিকান কংগ্রেসে বাইডেনের জয় নিশ্চিতের মিটিংয়ের দিকে। তার ধারনা ছিলো এখান থেকেই সিনেটররা বাইডেনের জয় আটকিয়ে দিতে পারবে।উগ্র ট্রাম্প সমার্থকরা রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে সশস্ত্র আক্রমণ করে বসল।তারা প্রায় কংগ্রেস ভবনের দখল নিয়েই নিয়েছিলো। আমেরিকার ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীনই বলা চলে।এ ঘটনায় পাঁচজন মৃত্যুবরন করেছে। গত চার বছর ধরে ট্রাম্প একের পর মিথ্যা ও উগ্র আচরণের কারনে আমেরিকার মানুষ সহ পুরো বিশ্বের সবাই তার উপর বিরক্ত ছিলেন। সবগুলো জরিপেও এমন আভাস ছিলো ট্রাম্প পরাজয় বরন করবেন। হয়েছেও তাই। কিন্তু লক্ষ্যনীয় বিষয় ট্রাম্প হারলেও আগের থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন। প্রায় সাড়ে সাত কোটি ভোট পেয়েছেন যা আগের নির্বাচনের তুলনায়ও বেশি। তাহলে ট্রাম্পের এতো ভক্ত কেমনে হলো? আসলে ট্রাম্প মূলত জনতুষ্টবাদী, শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্য ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রচারক ছিলেন।
বিভিন্ন সোসাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ন্যাটিভ শ্বেতাঙ্গদের তিনি নিজের কাছে টানতে পেরেছেন। আমেরিকা ফাস্ট,মেইক আমেরিকা গ্রেইট এগেইন স্লোগানে তার নির্বাচনি প্রচারে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিলো। ট্রাম্পের সময়ে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি প্রায় ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গিয়েছে। ট্রাম্প অভিবাসীদের ঘোর বিরোধী ছিলেন।এটা ন্যাটিভ আমেরিকানরা সাদরে গ্রহন করেছিলো।এটাও ঠিক সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন অভিবাসী আমেরিকা পাড়ি দিয়ে স্বচ্ছল জীবনযাপন করলেও খোদ সাদা আমেরিকানদের জীবনমান ছিলো তুলনামূলক খারাপ। এই কারনগুলো ট্রাম্পকে এক উগ্র সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করে দিয়েছে।ভবিষ্যতে ট্রাম্প না থাকলেও আমেরিকার রাজনীতিতে ট্রাম্পিজমের প্রভাব সহসায় যাবেনা।বাইডেন প্রশাসনের জন্য ক্ষমতার গ্রহনের পর এই বিভেদ দূর করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যাই হোক এবার আসি হেডলাইন প্রসঙ্গে, ক্যাপিটল হিলের ঘটনায় অনেকেই বলছেন আমেরিকার গণতন্ত্র এই বুঝি শেষ। চীন, ইরান সহ বিভিন্ন দেশ আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রকাশ্য নিন্দা করছে।এটা অবশ্যই আমেরিকার জন্য লজ্জাজনক একটা অধ্যায় হয়ে থাকবে, তবে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে আমেরিকা আমেরিকাই! এমনিতেই তাদের গণতন্ত্রের রোল মডেল বলা হয়না। গত চারবছর অব্যাহত পাগলামি, চাপ নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ জানুয়ারি জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সেক্রেটারি অব স্টেট ব্র্যাড রাফেনসপারজারকে ফোন করে ফল পাল্টানোর কথা বলেন। এতো কিছুর পরও কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই ট্রাম্পের হুমকি দেখে ভয় পায়নি। তার দল রিপাবলিকান দলের কর্মকতা হয়েও প্রেসিডেন্ট এর হুমকি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করছেন। ক্যাপিটল হিলের ন্যাক্করজনক ঘটনার পরও আমেরিকান সিনেটররা গভীর রাতে আবার বসে বাইডেনের জয় সত্যায়িত করছেন।
মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ জে. মার্ক মিলি সংবাদ সম্মেলনে যথার্থই বলেছেন, “আমরা কোন রাণী , রাজা , অত্যাচারী বা স্বৈরশাসকের সেবা করার জন্য শপথ নেইনি , কিংবা নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির জন্যও নয়। আমরা শপথ নিয়েছি মার্কিন সংবিধানের মর্যাদা রক্ষায়। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে যেয়ে আমরা আমাদের সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা রক্ষা করবো।প্রেসিডেন্টের চাপেও যাদের নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন কর্মকতা, তার নিজ দলের সিনেটর, নিজের নিয়োগকৃত বিচারক কেউই তাকে অনৈতিক ভাবে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করেনি তখনই বুঝা যায় আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা শক্তিশালী। কোন বাধাই তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করা থেকে টলাতে পারেনি। অথচ এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমেদের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশে নাই বললেই চলে। এখানে কাগজে কলমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হলেও সব কলকাঠি যখন যে সরকার থাকে তারাই নাড়ে। প্রতিষ্ঠান গুলোকে দাঁড়াতেই দেওয়া হয়না। সব দলের একই চরিত্র। সবাই ক্ষমতায় থাকার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।
বড় দুইটা রাজনৈতিক দলের ইতিহাস ঘাটলে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। যতদিন পর্যন্ত আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাড়াতে দেওয়া হবেনা ততদিন আমরা গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বাদ পাবোনা। এতো চাপ, সহিংসতা, হুমকি সব কিছুর পরও আমেরিকান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করে জনগণের রায়ের পক্ষেই বাইডেনের জয় নিশ্চিত করতে পেরেছে। তাই বলাই যায় হ্যাঁ এটাই আমেরিকান গণতন্ত্রের সৌন্দর্য!!!
খুলনা গেজেট/কেএম