এখন আর গায়ে সেই রক্তের তেজ নেই। চলাচল করতে পারিনা। স্বার্থপরের মতো সবাই আমাকে ফেলে দিয়েছে। সবাই থাকতেও আজ আমি নিঃস্ব। এখন আমার এক প্রতিবেশী সাইফুলের মাছের ঘেরে থাকি। ওই ছেলেটা আমাকে দেখাশোনা করে।’ এভাবে গভীর কন্ঠে দীর্ঘ নিঃস্বাসে কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলাম তানান (৬৯)।
এখন বয়সের সাথে শরীরে বার্ধক্য চলে এসেছে। এক সময় তার গায়ে তাজা রক্তের তেজে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি কেউ। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে দেশকে শত্রু মুক্ত করতে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রাতের আধারে পালিয়ে যান ঘর থেকে। এরপর আশ্রয় নেন সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী একটি রিকোর্টিং ক্যাপে। ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের জন্য। সেখানে বয়সে সব থেকে ছোট্ট ছিলেন নূর ইসলাম। তাই সাবাই ভালোবেসে চক্ষু মিয়া ডাকতেন।
কিছুদিন পর ওখান থেকে রাইফেল ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতের বিহারে পাঠানো হয় চক্ষু মিয়াকে। ট্রেনিং শেষে যোগদান করেন সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার দেহভাটা ক্যাম্পে সেখানে ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাস্টারের আন্ডারে প্রথমে পারুলিয়া সম্মুখ যুদ্ধে যোগদান করেন। এরপর যান ক্যাপ্টেন আরফিনের নেতৃত্বে চম্পাপুল এলাকায় পাকবাহেনির ক্যাম্প ধ্বংস করতে ঝাপিয়ে পড়েন এক রাতে।
কলরোয়া উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ক্যাম্প, সেখানে পাক বাহিনিরা আক্রমণ করে ৪ জনকে তুলে নিয়ে যায়। তখন তিনি ধান ক্ষেতে ঘাসের ঢিভির ভিতর লুকিয়ে আত্মগোপন করেন। দেশকে শত্রু মুক্ত করতে এক জেলা থেকে অন্য জেলা ছুটে ছিলেন তিনি। খুলনার কপিলমুনি, ডুমুরিয়া, বারয়াড়িয়া, সাচিবুনি, গল্লামারি, জেলখানা ঘাট এসব জায়গায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশও নেন নূর ইসলাম। জেলখানা ঘাটে যুদ্ধ করতে করতে তার পাশে থাকা সহযোদ্ধা পাকিস্তানিদের গুলিতে নিহত হন। তবুও পিছু হটেননি, শত্রুর সাথে লড়াই করে গিয়েছিলেন।
এক দিন পাকিস্তানি মিলিটারিদের গাড়ি দেখে একাই আক্রমণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন মাথায় গুরুতর জখম হন। সেই জখম নিয়ে মাত্র দুই দিন পরে আবারও যুদ্ধে যোগদেন। লড়াই করে দেশকে শত্রুমুক্ত করা, বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসা সেই বীর যোদ্ধা আজ জীবন যুদ্ধের পরাজিত সৈনিক।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ফিরে আসেন। দেশ স্বাধীনের ১১ বছর পর তার বিয়ে হয়। এর পর সাতক্ষীরায় একটি জুটমিলে শ্রমিকের কাজ নেন আর আবসর সময়ে রিক্সা চালিয়ে ভাড়া বাসায় চলছিলো তার নতুন জীবন যুদ্ধ । তিল তিল করে টাকা জমিয়ে স্ত্রী হোসনেয়ারা খাতুনের নামে ৭ কাটা জমি কিনে সেখানেই ঘর বাঁধেন। তাদের ঘর আলো করে একে একে ২ ছেলেও এক মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। এর মধ্যে তার ভাইয়েরা তার অংশের সম্পত্তি থেকে কৌশলে তাকে বঞ্চিত করে।
সব হারিয়েও নতুন উদ্যমে শুরু করেন তিনি। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে কঠোর পরিশ্রম করে পরিবর্তন করেন নিজের ভাগ্যটাকে। পরিশ্রম করে ছেলে মেয়েদের লেখা পড়াও শিখিয়েছেন। কিন্তু এতো কিছু করেও তার স্ত্রী হোসনেয়ারা তার কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।
এরপর তিনি তার জন্মভূমি সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকা খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালি ইউনিয়নের লালুয়া বাগালি গ্রামে ফিরে আসেন। সেখানে ঘর বাঁধার মতো কোন জায়গা না থাকায় এক প্রতিবেশির মাছের ঘেরে মানবতার জীবন পার করছেন। ২০২০ সালে স্ট্রোক জনিত কারণে তার শরীরের এক পাশ অকেজো হয়ে পড়েছে। তার বড় ছেলে হাসানুর জামান বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ বাংলা ব্যাংকে কর্মরত আর ছোট ছেলে ড্রাইভার এবং এক মাত্র মেয়ে মরিয়াম লেখাপড়া শেষ করেছে। তবুও তার এমন সময়ে দেখতে আসেনা স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে। সবাই থাকতে জীবন যুদ্ধে এখন প্রতিবেশি সাইফুল তার চলার অবলম্বন। এ অবস্থায় নিজের ঘরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলাম তানান। এটাই এখন সরকারের কাছে তার একমাত্র চাওয়া।
খুলনা গেজেট/ এস আই