আরব থেকে বাংলা সমুদ্রপথে বাণিজ্য হতো ইসলামপূর্বকাল থেকেই। চট্টগ্রাম বন্দর ছিল এতদঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমুদ্রবন্দর। আরবদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাংলায়, বাণিজ্যের সূত্রে। আরব বণিকরা বাংলায় আসলেও বাঙালিদের আরব-যাত্রা নিয়ে তেমন কোনো হদিস মেলেনি। একে তো বাঙালি সমুদ্রপথে আনাড়ি, তার উপর মাঝপথে পর্তুগিজ ও অন্যান্য জলদস্যুদের আক্রমণের আতঙ্ক তো ছিলই। যে কারণে বাঙালিদের সমুদ্রপথে নামাটা দুঃসাধ্যই ছিল একপ্রকার। ফলে, কেবল বাঙালি মুসলমান নয়, উপমহাদেশের যে কোনো মুসলমানের জন্য হজ পালন করাটা ছিল রীতিমতো দুঃসাহসী ব্যাপার। এই দুঃসাহসী কাজটা করেছেন কিছু মহিয়সি নারী— যাদের নিয়ে আজকের আয়োজন।
এ-যাবৎ প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাঙালি মুসলমান নারী হিসেবে প্রথমদিকে হজযাত্রার সৌভাগ্য অর্জন করেন বেগম সাওলাতুন্নিসা। তিনি জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার ভাসলিয়া গ্রামে, ১৮৩২ সালে। সম্পর্কে তিনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র নানী। তার বিয়ে হয় বেলেঘাটার জমিদার মুন্সী লতাফৎ হোসেনের সঙ্গে। ১৮৭২ সালে মুন্সী সাহেব তার জমিদারি স্ত্রীর নামে লিখে দেন এবং পরের বছরই তিনি ইন্তেকাল করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সাওলাতুন্নিসা কলকাতা, ২৪ পরগনা ও নদীয়ার বিভিন্ন জায়গায় কাছারি স্থাপন করে জমিদারি পরিচালনা করতে থাকেন। ১৮৭৫ সালে তিনি হজের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন তার নাবালক পুত্র, বিবাহিত কন্যা, জামাতা এবং নিকটাত্মীয়। ইতিহাসের দিক থেকে, সম্রাট বাবরের কনিষ্ঠ কন্যা গুলবদন বেগমের হজে রওনা হবার ঠিক ৩০০ বছর পর আরেক বাঙালি মুসলিম নারী রওনা হলেন, পরিবারসহ।
আরবদেশে সহি সালামতে পৌঁছে তিনি হজ সম্পন্ন করেন। হজ সম্পন্ন করার পর, মক্কায় বসবাসকারী হিন্দুস্তানের আলেম মাওলানা মুহম্মদ রহমতুল্লাহ সাহেবের কাছে তিনি ৩০ হাজার টাকা দেন একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য। মাওলানা সাহেব উপযুক্ত জমি কিনে মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার নাম দেওয়া হয়— মাদ্রাসায়ে সাওলাতিয়া হিন্দিয়া। দেশে ফেরার পরও তিনি ভোলেননি সে মাদ্রাসার কথা; জমিদারির আয়ের উৎস থেকে মাদ্রাসার জন্য বাৎসরিক একটি আর্থিক বরাদ্দ ধার্য করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি কেবল একবার নয়, বরং ছয় ছয়বার হজ পালন করার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং প্রতিবারই আলাদা আলাদাভাবে! এটা তো আজ ২০২৪ সালেও চিন্তা করা কঠিন যে, একজন বাঙালি মুসলমান নারী ১৫০ বছর আগে, ছয় ছয়বার জাহাজে চড়ে সুদূর আরবদেশে হজ পালন করতে গিয়েছেন। এই কঠিনেরেই ভালোবেসেছিলেন মহিয়সি বেগম সাওলাতুন্নিসা।
১৯৫৫ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হজে গিয়েছিলেন। সেবার মক্কায় অবস্থিত তার নানীর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা পরিদর্শন করেন তিনি।
সাওলাতুন্নিসা প্রথমবার হজে যাওয়ার ১৯ বছর পর, ১৮৯৪ সালে হজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন বিখ্যাত জমিদার নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। সাওলাতুন্নিসার মতো তিনিও ছিলেন জমিদার এবং স্বামীহারা— উভয়েই স্বামীর ইন্তেকালের পর সপরিবারে হজ করেন। ফয়জুন্নেসার কাফেলায় ছিল কন্যা বদরুন্নেছা, জামাতা ছৈয়দ শাহ্ আযহারুল হক এবং নাতি সৈয়দ শাহ গাজীউল হক। তিনি মক্কায় পৌঁছেন যথাসময়ে কিন্তু অসুস্থতার কারণে তার পক্ষে তাৎক্ষণিক হজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে বছরখানেক তিনি মক্কার মেছপালা মহল্লায় অবস্থান করেন। এই এক বছরের মধ্যে তিনি বেশ কিছু জনহিতকর কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
প্রথমত, বেগম সাওলাতুন্নিসার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও ফুরকানিয়া মাদ্রাসার জন্য ৩০০ করে ৬০০ টাকা বাৎসরিক দানের ব্যবস্থা করেন। দেশে ফেরার পরও প্রতি বছর এই অর্থ নিয়মিত মক্কায় পাঠানো হতো। তার কন্যা বদরুন্নেছা পরবর্তীতে সম্পত্তির ওয়াকফতে মক্কা শরীফে বাৎসরিক অর্থ প্রেরণকে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি যে মেছপালা মহল্লায় থাকতেন সেখানে একটি মুসাফিরখানা এবং একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান দুটির জন্যও নিয়মিত আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজের আমলে রাস্তা নির্মাণের কারণে উক্ত মুসাফিরখানা ও মাদ্রাসাটি ভেঙে ফেলা হয়। এর সর্বশেষ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন নোয়াখালী জেলার চৌমুহনীর অধিবাসী কারী নূরুল হুদা।
তৃতীয়ত, বিখ্যাত আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী বেগম জুবায়দা হাজিদের সুবিধার জন্য একটি খাল খনন করেছিলেন। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে খালটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। ফয়জুন্নেসা নিজস্ব তত্ত্বাবধানে উক্ত খালটি পুনরায় খনন করান এবং নানাবিধ সংস্কারের ব্যবস্থা করেন। ফলে, হাজিগণ পূর্বের ন্যায় আবারো খালটি ব্যবহারের সুযোগ পেলো।
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হজ সম্পন্ন করেন কুমিল্লা থেকে ১৮৯৫ সালে এবং সে বছরই তিনি সুস্থাবস্থায় দেশে ফিরে আসেন। হজ থেকে ফিরে আসার পর ৭ বছর বেঁচেছিলেন তিনি।
সিলেট থেকে দুইজন নারী উনিশ শতকেই হজ সম্পন্ন করেন। একজন সৈয়দ মুজতবা আলীর বাবা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকন্দর আলীর নানী। তিনি বেকামুরা গ্রামের সৈয়দ জুলফিকার আলীর কন্যা; জন্মগ্রহণ করেন ১৮১৮ সালে। উপরের দুইজন হাজীর চেয়ে তিনি ছিলেন বয়সে বড়। ১৮৩৩ সালে তার বিয়ে হয়। তিনি জীবদ্দশায় দুইবার হজ সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু কোন সালে বা কোন সময়ে করেছিলেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে, ধারণা করছি উনিশ শতকেই সম্পন্ন করেন হজ। কারণ ১৯০০ সালে তার বয়স দাঁড়ায়— ৮২। এই বয়সের পর জাহাজের বিপদসংকুল ও সময়সাপেক্ষ সফরে হজে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। যাই হোক, তিনি ১৯০৮ সালে ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার সমুদয় সম্পত্তি তিনি নাতি সৈয়দ সিকন্দর আলীকে দান করে যান।
আরেকজন সহিফা বানু— যিনি সিলেটের প্রথম মুসলিম মহিলা কবির মর্যাদায় খ্যাত। সম্পর্কে তিনি মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজার বৈমাত্রেয় বোন। অর্থাৎ হাসন রাজার বাবা সৈয়দ আলী রাজার তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান ছিলেন সহিফা বানু আর পঞ্চম স্ত্রীর সন্তান হাসন রাজা। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫১ সালে। জীবদ্দশায় তিনি তিনবার সমুদ্রপথে হজ সম্পন্ন করেন। সিলেট থেকে সে সময়ে হজের রাস্তা ছিল এরকম— সিলেট থেকে চাঁদপুর লঞ্চঘাট, চাঁদপুর থেকে গোয়ালন্দ ঘাট, গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে মুম্বাই এবং মুম্বাই থেকে জাহাজযোগে আরবদেশে যাত্রা। কোন কোন সালে তিনি হজ পালন করেন তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন সজিদা বানু এবং ভ্রাতুষ্পুত্র দেওয়ান আজিজুর রাজা। তিনি হজ করেছেন বলে তাকে স্থানীয় লোকজন ‘হাজী বিবি’ নামে ডাকতো। সুনামগঞ্জে ‘হাজীবিবি হাউস’ নামে তার একটি বাড়িও ছিল, যেটি ১৯০৮ সালে আগুনে পুড়ে যায়। ১৯০৬ সালে তার স্বামী ইন্তেকাল করেন এবং এই শোকে তিনি স্থায়ীভাবে মক্কা-মদিনায় গিয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার রচিত গানেই আছে এই কথা—
“বাংলাদেশে জন্ম লইয়া না হইল সুখ
মদিনাতে গেলে আমার সফল হইবে দুখ
যখনে যাইমু আমি মদিনা শহর
মোমের পঞ্চ বাত্তি দিমু এলাহির নজর।
যদি আল্লাহ দেখায় মোরে রসুলউল্লাহর ঘর
পঞ্চ দুম্বা সির্ন্নি দিমু হেরেমেরে ভিতর।
জীবন থাকিতে যার হইবে মরন
ইহকালে পরকালে সফল তার জীবন।
সহিফায়ে বলে দেশে থাকিয়া কিবা সার
একদিন ত ছাড়তে হবে এই ভবের বাজার।”
কিন্তু ছোট ভাই হাসন রাজার অনুরোধে তিনি এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেশেই থেকে যান। ১৯১৭ সালে, ৬৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন এবং হজরত শাহজালালের মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে তার কবর রয়েছে।
উনিশ শতকে হজ পালন করা চারজন নারীর হজ সংক্রান্ত এবং অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে কিছু বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। যেমন:
১. বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীদের পিছিয়ে পড়ার যে ঘটনা আমরা প্রায়শই শুনি তার মূল কারণ অর্থনৈতিক। বেগম সাওলাতুন্নিসা এবং ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী— দুইজনই ছিলেন জমিদার; সৈয়দ সিকন্দর আলীর নানী এবং সহিফা বানু দুইজনেই পিতা ও স্বামী উভয়দিক থেকে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণেই উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও হজে যেতে পেরেছিলেন।
২. চারজনের মধ্যে তিনজনই একাধিকবার হজ সম্পন্ন করেছেন এবং সহি সালামতে ফিরে এসেছেন। ভৌগলিক কারণে স্থল ও সমুদ্রপথের এত পরিশ্রমসাধ্য, বিপদসংকুল যাত্রাপথ হওয়া সত্ত্বেও কোনো শারীরিক বাধাবিপত্তি হয়নি। উনিশ শতকে এই ঘটনা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! একজন ছয়বার, একজন তিনবার এবং আরেকজন দুইবার— বর্তমানের আধুনিক চিকিৎসা, আবাসন ও যাতায়াতের অঢেল সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও তো একজন নারীর পক্ষে একাধিকবার হজ করাটা সহজ ব্যাপার নয়। আবার ফিরে আসার পর সফরের ধকলে দুর্বল হয়ে পড়েছেন এমন নয়, বরং চারজনই পরবর্তীতে যথেষ্ট সময় বেঁচেও ছিলেন। বাঙালি নারীর শারীরিক সবলতার দিকটা এতে স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে।
৩. অর্থনৈতিক সক্ষমতা একজন নারীর মানসিক সক্ষমতারও জোগান দেয়। ধর্মের নামে প্রচার করা অনেক ঠুনকো বিধিনিষেধের বেড়াও ভেঙে পড়ে অর্থনৈতিক সক্ষমতার সামনে।
বলা যায়, উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমান নারীর সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠিত বয়ানের বিপরীতে অন্য এক বয়ানের সন্ধান আমরা পাচ্ছি। এর মাধ্যমে ইতিহাসের কিছু অন্ধকার কোঠরে আলো ফেলার দিশা পাওয়া যেতে পারে।
খুলনা গেজেট/এনএম